Friday 20 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইসরায়েল-ইরান সংঘাত
দুই দেশের অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়ছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২০ জুন ২০২৫ ১৯:৫৬ | আপডেট: ২০ জুন ২০২৫ ২০:১৮

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত। ছবি: সংগৃহীত

টানা সাত দিন ধরে ইসরায়েল ও ইরান একে অপরের ওপর হামলা চালাচ্ছে, যা মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় আকারের সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করেছে। তবে এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে উভয় দেশের পক্ষে তা চালিয়ে যাওয়ার আর্থিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

শুক্রবার (২০ জুন) আল-জাজিরার প্রতিবেদক অ্যালেক্স কোজুল-রাইট এ সম্পর্কিত একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। এখানে সেই প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো।

শুক্রবার (২০ জুন) ইসরায়েল ইরানের বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ও পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে এবং দেশটির কিছু পরমাণু স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। এরপর তারা ইরানের জীবাশ্ম জ্বালানি খাতেরও কিছু অংশের ক্ষতি করেছে। জবাবে ইরান ইসরায়েলের সরকারি ভবন ও শহরগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এই সংঘাত উভয় দেশের জন্য শত শত কোটি ডলার ব্যয়বহুল হচ্ছে, যা তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে।

ইসরায়েলের যুদ্ধের ব্যয়

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের দীর্ঘ সামরিক অভিযান এবং ইরানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘাত দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল সময় নিয়ে এসেছে।

ইসরায়েলি ব্যবসায়িক সংবাদপত্র ক্যালকালিস্টের জানুয়ারির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ শুধু গাজা যুদ্ধের সম্মিলিত ব্যয় ২৫০ বিলিয়ন শেকেলে (প্রায় ৬৭.৫ বিলিয়ন ডলার) পৌঁছেছে।

ইসরায়েলি সংবাদ সংস্থা ওয়াইনেট নিউজের ১৫ জুনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের সঙ্গে প্রথম দুই দিনের লড়াইয়ে ইসরায়েলের খরচ হয়েছে ৫.৫ বিলিয়ন শেকেল (প্রায় ১.৪৫ বিলিয়ন ডলার)। এই হারে সংঘাত চললে সাত সপ্তাহের মধ্যে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ গাজার যুদ্ধের মোট ব্যয়কে ছাড়িয়ে যাবে।

২০২৩ সালে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল ৬০ বিলিয়ন শেকেল (১৭ বিলিয়ন ডলার), যা ২০২৪ সালে ৯৯ বিলিয়ন শেকেলে (২৮ বিলিয়ন ডলার) উন্নীত হয়েছে। ২০২৫ সালের জন্য এটি ১১৮ বিলিয়ন শেকেলে (৩৪ বিলিয়ন ডলার) পৌঁছাতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় এই অর্থবছরের জন্য ইসরায়েলের জিডিপির ৪.৯ শতাংশ (১০৫ বিলিয়ন শেকেল বা ২৭.৬ বিলিয়ন ডলার) ঘাটতি সীমা নির্ধারণ করেছে, যা উচ্চ সামরিক ব্যয়ের কারণে হুমকির মুখে পড়তে পারে।

ইসরায়েলের ঋণ এবং অর্থনীতির ওপর প্রভাব

যদিও প্রত্যাশিত কর রাজস্ব বেড়েছে, তবুও ২০২৫ সালের জন্য ইসরায়েলের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৪.৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩.৬ শতাংশ করা হয়েছে।

ব্যবসায়িক জরিপ সংস্থা কোফেসবিডিআই (CofaceBDI) অনুসারে, জনবলের অভাব, সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত এবং দুর্বল ব্যবসায়িক পরিবেশের কারণে ২০২৪ সালে প্রায় ৬০ হাজার ইসরায়েলি কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। পর্যটকদের আগমনও প্রাক-অক্টোবর ২০২৩ স্তরের নিচে রয়ে গেছে।

এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংস সতর্ক করেছে, ইসরায়েলের যুদ্ধ যদি চলতে থাকে এবং ইরানের কাছ থেকে শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া আসে, তাহলে ইসরায়েলের ক্রেডিট রেটিং এ থেকে এ- তে নামিয়ে আনা হতে পারে। এর ফলে ঋণ গ্রহণের ব্যয় বাড়বে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমবে।

ইরানের জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের ওপর প্রভাব

কেপ্লারের (Kpler) তথ্য অনুযায়ী, ইরানের তেল রফতানি নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। রোববার শেষ হওয়া সপ্তাহে মোট অপরিশোধিত তেল ও কনডেনসেট রফতানি ১ লাখ ২ হাজার ব্যারেল প্রতিদিন (bpd) হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, যা এই বছরের গড় রফতানির অর্ধেকেরও কম।

গুরুত্বপূর্ণভাবে, খার্গ দ্বীপ থেকে, যেখান থেকে ইরান তার ৯০ শতাংশের বেশি তেল রফতানি করে, শুক্রবার থেকে রফতানি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। এলএসইজি (LSEG) স্যাটেলাইট জাহাজ ট্র্যাকিং ডেটা অনুসারে, সোমবার খার্গ দ্বীপে কোনো ট্যাঙ্কার নোঙর করা ছিল না।

ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইআইএ) অনুসারে, ২০২৫ সালে ইরান গড়ে ৩.৪ মিলিয়ন ব্যারেল প্রতিদিন অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করেছে, যার প্রধান বিদেশি ক্রেতা ছিল চীন।

ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে উপসাগরের সাউথ পার্স গ্যাসফিল্ডে ইরানের গ্যাস উৎপাদন আংশিকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। সাউথ পার্স, যা ইরান কাতারের সঙ্গে ভাগ করে নেয়, এটি বিশ্বের বৃহত্তম গ্যাসফিল্ড এবং ইরানের মোট গ্যাস উৎপাদনের প্রায় ৮০ শতাংশ উৎপাদন করে।

ইসরায়েল তেহরানের বাইরে শাহর রে রিফাইনারি এবং রাজধানীর আশেপাশে জ্বালানি ডিপোকেও লক্ষ্যবস্তু করেছে। উৎপাদনের ওপর এই হামলার পূর্ণ প্রভাব অজানা।

ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার ভূমিকা

১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লব ও মার্কিন দূতাবাস জিম্মি সংকটের পর থেকেই ইরান মার্কিন নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন। পরমাণু কর্মসূচির কারণেও তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়।

তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসন অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে বিশ্বের একাধিক প্রধান অর্থনীতিকে ইরান থেকে তেল ক্রয় কমাতে বা বন্ধ করতে উৎসাহিত করেছিল।

২০১৫ সালের জেসিপিওএ চুক্তির পর নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলেও, ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন এবং আরও বাড়ান। এর ফলে তেহরানের তেল রফতানি আয় মারাত্মকভাবে কমে যায়। ইআইএ অনুসারে, ২০২২ ও ২০২৩ সালে তেল রফতানি থেকে মাত্র ৫০ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে, যা ২০১৬ সালের ১০ শতাংশেরও কম।

নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের বৈদেশিক মুদ্রা আয় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত করছে এবং জরাজীর্ণ অবকাঠামো মেরামতের ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে।

প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বারবার দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন, এমনকি ১৯৮০-এর দশকের ইরান-ইরাক যুদ্ধের চেয়েও বর্তমান পরিস্থিতিকে বেশি চ্যালেঞ্জিং বলে অভিহিত করেছেন।

ইরানের অন্যান্য চ্যালেঞ্জ

শক্তি ও পানির সংকট, মুদ্রার পতন এবং আঞ্চলিক মিত্রদের সামরিক পরাজয় – এই সবকিছুই নিষেধাজ্ঞার কারণে আরও তীব্র হয়েছে। বিনিয়োগের অভাব, প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন হ্রাস এবং অদক্ষ সেচ বিদ্যুতের ব্ল্যাকআউট ও পানির সংকটের কারণ হচ্ছে।

বৈদেশিক মুদ্রা ওয়েবসাইট অনুসারে, ২০১৮ সালে নিষেধাজ্ঞা পুনরায় আরোপের পর থেকে ইরানের মুদ্রা রিয়াল ডলারের বিপরীতে ৯০ শতাংশেরও বেশি মূল্য হারিয়েছে। সরকারি মুদ্রাস্ফীতির হার প্রায় ৪০ শতাংশ হলেও, কিছু ইরানি বিশেষজ্ঞের মতে প্রকৃত হার ৫০ শতাংশের বেশি।

জানুয়ারিতে তাসনিম বার্তা সংস্থা জানায়, ২২ থেকে ২৭ শতাংশ ইরানি এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। বেকারত্বের হার ৯.২ শতাংশ হলেও, প্রকৃত চিত্র আরও খারাপ বলে শ্রমিকদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থাগুলো অনুমান করেছে।

ইরান কত ব্যয় করতে পারে?

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক হামজেহ আল গাউদের মতে, তেহরানের ‘সামরিক উদ্দেশ্যে তুলনামূলকভাবে ছোট বাজেট’ রয়েছে। তিনি অনুমান করেছেন, ইরানের জিডিপির ৩ থেকে ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় হয়, যা প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের সমান।

তেহরানের ৩৩ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে যা তারা তাত্ত্বিকভাবে ব্যবহার করতে পারে। তবে আল গাউদ বলেছেন, ‘এখান থেকেই ইরান পিছিয়ে আছে। স্বল্পমেয়াদী সামরিক সংঘাতের জন্য রিজার্ভ ব্যবহার করলে দীর্ঘমেয়াদের জন্য তাদের পঙ্গু করে দেবে।’

তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ‘পতাকার নিচে সমাবেশ’ মনোভাব দেখা গেলেও, যদি ইরান আরও হামলা এবং বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনার সম্মুখীন হয়, তবে সেই সমর্থন সহজেই দুর্বল হয়ে যেতে পারে।’

সারাবাংলা/এইচআই

ইরান ইসরায়েল-ইরান সংঘাত মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর