Saturday 21 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধি
সরাসরি যুদ্ধ, নাকি ইসরায়েলকে সহায়তার প্রস্তুতি যুক্তরাষ্ট্রের!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২২ জুন ২০২৫ ০০:২০ | আপডেট: ২২ জুন ২০২৫ ০০:২৬

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক তৎপরতা বাড়ছে। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাজ্যের আকাশপথ দিয়ে মার্কিন সামরিক বিমানগুলো ব্যাপকহারে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যাচ্ছে। এরকমটা এর আগে দেখা যায়নি। এই সামরিক তৎপরতা থেকেই বোঝা যায়, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সরাসরি সহায়তার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র চায়, ইসরায়েল ইরানে এই হামলা অব্যাহত রাখুক এবং সেজন্য সবধরনের সহযোগিতা নিয়ে তাদের পাশে রয়েছে মার্কিনিরা।

শনিবার (২১ জুন) যুক্তরাজ্যভিত্তিক গণমাধ্যম স্কাই নিউজে এ সম্পর্কিত একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানগুলোর সাম্প্রতিক ফ্লাইট ডাটা এবং সামরিক বিশ্লেষণের আলোকে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে মূলত ইরান-ইসরালে যুদ্ধ পরিকল্পনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তারা সরাসরি নাকি ইসরায়েলকে সহায়তা করতে চায়- সেটি নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী ধারণা করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ফ্লাইট ট্র্যাকিং ডাটা অনুযায়ী, সোমবার (১৬ জুন) থেকে বৃহস্পতিবারের (১৯ জুন) মধ্যে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের ওপর দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে ৫২টি মার্কিন সামরিক বিমান উড়তে দেখা গেছে। এর মধ্যে অন্তত ২৫টি বিমান গ্রিসের ক্রিট দ্বীপের চানিয়া বিমানবন্দর ব্যবহার করেছে, যা জুনের প্রথম অর্ধেকের তুলনায় আটগুণ বেশি। এই ৫২টি বিমানের মধ্যে ৩২টি সৈন্য বা পণ্য পরিবহণে, ১৮টি মাঝ আকাশে জ্বালানি ভরতে এবং দু’টি গোয়েন্দা কাজে ব্যবহার হয়েছে।

ম্যাকেনজি ইন্টেলিজেন্সের প্রতিষ্ঠাতা ফোর্বস ম্যাকেঞ্জি বলেছেন, ‘আগে এই অঞ্চলে এমন যুদ্ধ পরিচালনার সামগ্রিক সক্ষমতা দেখা যায়নি, যা এখন স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।’

স্কাই নিউজের তথ্য ফাইটার জেট বা যুদ্ধবিমানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে না, কারণ সেগুলোর অবস্থান সাধারণত প্রকাশ করা হয় না। তবে, বুধবারের (১৮ জুন) একটি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল রেকর্ডিং থেকে জানা যায়, এফ-২২ র‍্যাপ্টর যুদ্ধবিমানগুলো আটলান্টিকের ওপার থেকে পাঠানো হচ্ছে। একই দিনে ১২টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান যুক্তরাজ্য থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যাওয়ার সময় ছবি তোলা হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের বিমানবন্দরগুলোতে মার্কিন সামরিক বিমানের ভিড়

গত কয়েকদিনে যুক্তরাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিমান ঘাঁটিতে মার্কিন বিমান বাহিনীর আনাগোনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ১৬ থেকে ১৯ জুনের মধ্যে এই বিমান ঘাঁটিগুলোতে ৬৩টি মার্কিন সামরিক ফ্লাইট অবতরণ করেছে, যা জুনের শুরুর দিকের তুলনায় দ্বিগুণ। স্কাই নিউজ বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) গ্লাসগোর প্রেস্টউইক বিমানবন্দরে তিনটি মার্কিন সি-১৭এ গ্লোবমাস্টার, ৩ পরিবহণ বিমান এবং একটি সি-১৩০ হারকিউলিস সামরিক কার্গো বিমান অবতরণের দৃশ্য ধারণ করেছে। একটি বিমান জর্ডানের একটি বিমান ঘাঁটি থেকে এসেছিল, যা এর আগে জার্মানি থেকে সেখানে গিয়েছিল।

ইসরায়েলের যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কী প্রয়োজন?

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ১৫ মার্চ বলেছিলেন, তার দেশের লক্ষ্য হলো ‘দুটি অস্তিত্বগত হুমকি– একটি পারমাণবিক হুমকি এবং অপরটি ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হুমকি’ দূর করা। ইসরায়েল দাবি করে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা করছে। যদিও ইরান বলছে, তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো কেবল বেসামরিক জ্বালানি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়।

উল্লেখ্য, মার্চ মাসে মার্কিন গোয়েন্দা মূল্যায়নে বলা হয়েছিল, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে না। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মঙ্গলবার (১৭ জুন) এই মূল্যায়ন বাতিল করে বলেছেন, ‘আমি মনে করি তারা (ইরান) একটি পরমাণু অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি ছিল।’

ম্যাকেঞ্জি ইন্টেলিজেন্সের ফোর্বস ম্যাকেঞ্জি বলেছেন, ‘আমেরিকানদের কাছে যা আছে ইসরায়েলিদের প্রায় একই ধরনের অস্ত্রের মজুদ আছে। তবে, তাদের কাছে রয়েছে জিবিইউ-৫৭। এই ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের বোমাটি বিদ্যমান অ-পারমাণবিক বোমাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং এটি খুব গভীরে মাটির নিচে থাকা লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, যা ফোর্দোর একটি পাহাড়ের নিচে অবস্থিত, সেটি ধ্বংস করার একমাত্র সম্ভাবনা এই অস্ত্র দিয়েই রয়েছে।

মাঝ আকাশে জ্বালানি ভরার সক্ষমতা

পূর্ব ভূমধ্যসাগরের ওপর দিয়ে স্কাই নিউজ যে ডজন ডজন মার্কিন বিমান ট্র্যাক করেছে, তার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি (১৮টি বিমান) মাঝ আকাশে জ্বালানি ভরার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। স্কাই নিউজের সামরিক বিশ্লেষক শন বেল বলেছেন, ‘এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ইসরায়েল ইরান থেকে প্রায় এক হাজার মাইল দূরে। বেশিরভাগ সামরিক যুদ্ধবিমানের ২ হাজার মাইলের এই রাউন্ড ট্রিপ করতে এবং যথেষ্ট যুদ্ধ জ্বালানি রাখতে কষ্ট হবে।’

মাঝ আকাশে জ্বালানি ভরার সক্ষমতা ইসরায়েলি বিমানগুলোকে ভারী গোলাবারুদ বহন করতেও সাহায্য করবে, যার মধ্যে বাঙ্কার-বাস্টার বোমাও রয়েছে। এই বোমাগুলো ইরানের অনেক ক্ষেপণাস্ত্রের সুরক্ষায় ব্যবহৃত সুড়ঙ্গ ও সাইলো ধ্বংস করার জন্য অপরিহার্য। ১৫ জুনের স্যাটেলাইট চিত্রগুলোতে দেখা গেছে, ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় কেরমানশাহ শহরের কাছে একটি ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনায় ইসরায়েলি হামলার পর অন্তত ১২টি ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে।

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি ও সামরিক নেতৃত্বের ব্যাপক ক্ষতি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সহায়তা ছাড়াই, ইসরায়েলি বিমানবাহিনী ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ সক্ষমতার ওপর উল্লেখযোগ্য ক্ষতি সাধন করেছে। স্কাই নিউজ নিশ্চিত করেছে, ইসরায়েল দেশটির পশ্চিমে ইরানের ছয়টি পরিচিত ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটির অন্তত পাঁচটিতে হামলা চালিয়েছে। সোমবার ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে, পশ্চিমা উৎক্ষেপণ কেন্দ্রগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার তাদের কৌশল ইরানকে দেশের কেন্দ্রস্থলে, যেমন ইসফাহান (ইসরায়েল থেকে প্রায় ১,৫০০ কিলোমিটার বা ৯৩০ মাইল দূরে) অবস্থিত ঘাঁটিগুলোর ওপর নির্ভর করতে বাধ্য করেছে।

ইরানের সবচেয়ে উন্নত অস্ত্রগুলোর মধ্যে তিনটি কঠিন জ্বালানি চালিত রকেট ফাত্তাহ-১ , খাইবার শেকান এবং হাজ কাসেম রয়েছে। যেগুলোতে অত্যন্ত চালচলনযোগ্য ওয়ারহেড লাগানো আছে। কঠিন জ্বালানির ব্যবহার এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে সহজে পরিবহণ এবং দ্রুত উৎক্ষেপণযোগ্য করে তোলে। এদের চালচলনযোগ্য ওয়ারহেড ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে আরও দক্ষ করে তোলে। তবে, এদের কোনোটিই এত দূর থেকে ইসরায়েলে আঘাত হানতে সক্ষম নয়।

ইরানের কাছে ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে আঘাত হানতে সক্ষম পাঁচটি ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে বলে জানা যায়, তবে এর মধ্যে কেবল একটিই কঠিন জ্বালানি ব্যবহার করে; এটি হলো সিজ্জিল-১। ১৮ জুন ইরান দাবি করে যে, তারা এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করেছে।

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ক্ষয়ক্ষতি ও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা

ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলে অন্তত ২৪ জন নিহত এবং কয়েকশ মানুষ আহত হয়েছেন। ইরান কিছু সরকারি ভবনে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে, যার মধ্যে শুক্রবার হাইফা শহরের একটি ভবনও রয়েছে। ১৩ জুন ইরানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লক্ষ্যবস্তুতে সফল আঘাতের ঘটনা ঘটে, যখন একটি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র তেল আভিভের ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দফতরে বা তার কাছাকাছি আঘাত হানে।

তবে, স্কাই নিউজ দ্বারা যাচাই করা বেশিরভাগ ইরানি হামলা বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে আবাসিক ভবন, একটি স্কুল এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় অন্তর্ভুক্ত। বৃহস্পতিবার একটি ক্ষেপণাস্ত্র দক্ষিণের ইসরায়েলের প্রধান হাসপাতাল বেয়ারশেবার সোরোকা মেডিকেল সেন্টারে আঘাত হানে।

ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এতে ৭০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি দাবি করেন, ইরান কাছাকাছি একটি প্রযুক্তি পার্কে আঘাত হেনেছে যেখানে আইডিএফ এর সাইবার প্রতিরক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল এবং বিস্ফোরণের ঢেউ হাসপাতালের একটি ছোট অংশে সামান্য ক্ষতি করেছে।

এটি স্পষ্ট, নিহত সামরিক কর্মীদের মধ্যে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যার মধ্যে সামরিক বাহিনীর চিফ অফ স্টাফ, গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি হেড এবং অপারেশনস-এর ডেপুটি হেড উল্লেখযোগ্য। শক্তিশালী রেভল্যুশনারি গার্ডের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে মিলিশিয়াটির কমান্ডার-ইন-চিফ, এর অ্যারোস্পেস ফোর্সের কমান্ডার এবং এর বিমান প্রতিরক্ষা কমান্ডারও রয়েছেন।

বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য ইসরায়েলের মার্কিন সহায়তার প্রয়োজন নেই। আমরা আমাদের সমস্ত উদ্দেশ্য অর্জন করব এবং তাদের সমস্ত পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানব। আমাদের তা করার ক্ষমতা আছে।

ফোর্বস ম্যাকেঞ্জি বলছেন, ‘ইসরায়েল যুদ্ধে এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য বিজয় অর্জন করলেও, তাদের কাছে সীমিত জ্বালানি এবং সীমিত গোলাবারুদ আছে। মার্কিনদের সেই অপারেশনগুলোর গতি বজায় রাখার ক্ষমতা আছে যা ইসরায়েলিরা শুরু করেছে, এবং তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য তা করতে সক্ষম।’

সারাবাংলা/এইচআই/পিটিএম

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বৃদ্ধি মার্কিন তৎপরতা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর