ঢাকা: যশোরে কতজন মুক্তিযোদ্ধা, কতজন ভুয়া এবং এ পর্যন্ত কতজন মারা গেছেন- এর হিসেব পাওয়া কঠিন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করে তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দাবি ওঠে। তারও আগে সারাদেশে প্রায় ৪০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্ত করা হয়। সেসময়ও যশোরের চৌগাছা, শার্শা, ঝিকরগাছা, সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে নতুন গেজেট প্রকাশের দাবি জানানো হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে তালিকা সম্পূর্ণ হয়নি, এমনকি হয়নি পূর্ণাঙ্গ যাচাই-বাছাই। ফলে মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মনে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তালিকা সংশোধনের কথা ওঠে। কারও কারও দাবি, কেন্দ্রীয়ভাবে এ কাজ চলছে। তবে তার বাস্তব রূপ দেখতে পাচ্ছেন না কেউ-ই। এ অবস্থায় যশোরের মুক্তিযোদ্ধা তালিকা যাচাই-বাছাই শেষে ভুয়াদের বাদ দেওয়ার দাবি সব মহলের। কিন্তু জেলা প্রশাসন বা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এ জাতীয় কোনো নির্দেশনা আসেনি। তাই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ক্ষোভ বা বাদ দেওয়ার দাবি থাকলেও বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, যশোরে ২০১৭ সালে ৫৭ জন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্ত করা হয়েছিল। যার মধ্যে নয়জন ছিল রাজাকার। আবার ২০২০ সালে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে যশোরে ১৪ কনেস্টবলের চাকরি হয়েছিল। এ ছাড়া, অনেকেই ভুয়া সনদ ব্যবহার করে সরকারি-বেসরকারি চাকরি নিয়েছিল। অনেকেই কোটায় সরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছিল। এসব নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু সর্বজন গ্রহণযোগ্য তালিকা যশোরবাসী কখনই দেখতে পায়নি।
মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের গেজেট অনুযায়ী, যশোরে মোট মুক্তিযোদ্ধা ২ হাজার ৯৯৪ জন। এদের মধ্যে সদরে ১ হাজার ১৭৬ জন, অভয়নগরে ১৮০ জন, শার্শায় ২৯০ জন, বাঘারপাড়ায় ৩০৮ জন, চৌগাছায় ২৭২ জন, ঝিকরগাছায় ৩৭১জন, কেশবপুরে ৭৯ জন এবং মণিরামপুরে ৩১৮ জন। এদের বেশিরভাগই মারা গেছেন।
অবশ্য যশোরে তালিকাভুক্ত জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা কত তা সঠিকভাবে জানাতে পারেনি কেউ। বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল আলম সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সোনাালী ব্যাংকের মাধ্যমে আমরা ভাতা পাই। তাই সোনালী ব্যাংক সঠিক সংখ্যাটা জানাতে পারে। এ ছাড়া, উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা সঠিক সংখ্যা জানাতে পারে। তবে আনুমানিক ১৩০০ থেকে ১৪০০ কাছাকাছি মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছেন।’ একইরকম কথা বলেন সাবেক জেলা কমান্ডার মুজহারুল ইসলাম মন্টু। তার মতে, ১২০০ থেকে ১৩০০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবিত রয়েছেন।
যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাজিবুল আলম সারাবাংলাকে জানান, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের তালিকা অনুযায়ী জেলায় জীবিত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে এক হাজার ৩৬৪ জন। সে তালিকা মতে, সদরে ৫৫৫ জন, অভয়নগরে ৮৫ জন, শার্শায় ১১৬ জন, বাঘারপাড়ায় ১৩৬ জন, চৌগাছায় ১৪০ জন, ঝিকরগাছায় ১৫২জন, কেশবপুরে ৩৫ জন এবং মণিরামপুরে ১৪৫ জন। আর যশোর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শারমিন আক্তার জানান, বর্তমানে উপজেলায় জীবিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৫০৬ জন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যশোরের প্রধান সমন্বয়ক রাশেদ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘যশোরসহ সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংশোধন দরকার। নানা সময়ে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জুলাই আন্দোলনের পরও এই তালিকা সংশোধনের কথা হয়। গত ১৭ বছর তালিকায় নতুন নতুন নাম সংযোজিত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার খবর আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি। যশোরের তালিকা নিয়েও কথা উঠেছে বহুবার। এখন সময় এসছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার এবং যাাচাই-বাছাই শেষে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন করার। তালিকায় ভুয়া কেউ থাকলে প্রকৃতদের অবমাননা করা হবে।’
শার্শার বীর মুক্তিযোদ্ধা আনছার আলী সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘অবশ্যই যশোরের মুক্তিযোদ্ধা তালিকার যাচাই-বাছাই করা দরকার।’ তারও দাবি, এই তালিকায় ভুয়াদের অবস্থান রয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি জানান, তারা শার্শা উপজেলার তাালিকা যাচাই বাছাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে বিশেষ কারণে সে উদ্যোগ আর এগোয়নি। সে সময় তারা শার্শায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ২৫৭ কে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন।
যশোর সদরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক সারাবাংলাকে জানান, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আছে কিনা তা তিনি জানেন না। প্রয়োজনে যাচাই করে সঠিক তালিকা করা যেতে পারে। বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট রবিউল আলম বলেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা কে যাচাই করবেন, যখন দেশের ৬৫ ভাগ মুক্তিযোদ্ধাই মারা গেছেন। এখন কোন প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই হবে?’
জেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মুজহারুল ইসলাম মন্টু বলেন, ‘বিভিন্ন সময় ইন্টারেস্টেড গ্রুপ তালিকাভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছে। অনেকে সফলও হয়েছে। ১৯৯৬ সাল থেকে তালিকা সংশোধনের চেষ্টা হচ্ছে। এর আগে সারাদেশে ৪০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্ত হয়েছে। যশোরেও দুই/চারজন থাকতে পারে। আগের সরকারের সময় চিহ্নিত করা হলেও মন্ত্রণালয় অ্যাকশনে যেতে পারেনি। যদি ব্যবস্থা নেওয়া হতো তাহলে এই দুর্নাম থাকত না। বর্তমান সরকার ফের উদ্যোগ নিয়েছে। ভুয়াদের বাদ দিয়ে প্রকৃতদের গেজেটভুক্ত করা হলে বিতর্কের অবসান হবে। আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা তাদের ভাবমূর্তিও রক্ষা হয়।’ তিনি আরও বলেন, সরকার বা মন্ত্রলায় চাইলেই আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি। অতীতেও এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করেছি।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন সারাবাংলাকে জানান, যশোরের তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আছে। বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে যে আওয়ামী লীগ করতো প্রয়োজনে তাকেই মুক্তিযোদ্ধা বানানো হয়েছে। ফলে এই তালিকা সংশোধন ও যাচাই-বাছাই করা দরকার। এখন যদি বর্তমান সরকার এটি না করে তবে আগামীতেও যাচাই-বাছাই হতে পারে।’
যশোর জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানান, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই-বাছাই বিষয়ে কোনো নির্দেশনা তিনি পাননি। সরকারি নির্দেশনা যেভাবে আসবে সেভাবে কাজ করা হবে।