ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) শিক্ষার্থী ও স্যার এফ রহমান হল ছাত্রদলের সাহিত্য সম্পাদক শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার দেড় মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত উদঘাটন হয়নি এর জন্য দায়ী কে বা কারা? কী উদ্দেশ্যেই-বা তাকে হত্যা করা হয়েছে? এর পেছনে কি অন্য কোনো ষড়যন্ত্র আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সাম্যের পরিবার, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও।
গত ১৩ মে রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসংলগ্ন এলাকায় একদল দুর্বৃত্ত ছুরিকাঘাত করে শাহরিয়ার সাম্যকে। রক্তাক্ত অবস্থায় রাত ১২টার দিকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন ১৪ মে থেকেই ছাত্রদল সাম্য হত্যার বিচার চেয়ে ও ‘নিরাপদ ক্যাম্পাস দিতে ব্যার্থ’ হওয়ার দায় স্বীকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান ও প্রক্টর ড. সাইফুদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবি করে করতে থাকেন। ৩১ মে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে একই দাবি অব্যহত রাখার কথা জানান তারা। ছাত্রদলের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাম্য হত্যাকাণ্ডের পরে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পদত্যাগ দাবি করেছিলাম। শুধু সাম্য হত্যাকাণ্ড নয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর নিকট অতীতে যতগুলো ব্যর্থ ঘটনা ঘটেছে সেগুলোকে সামনে এনে তাদের পদত্যাগ দাবি করেছি। মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ড, চারুকলায় ফ্যাসিস্টের মোটিভ পোড়ানো, গণিত ভবনের সামনে ঝুলন্ত লাশ, হাসিনার ছবি সংবলিত ঘৃণাস্তম্ভ রাতের আঁধারে মুছে দেওয়া- এ ধরনের নানার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এসব দাবি উত্থাপন করেছি।’
ঢাবি প্রশাসনের পদত্যাগ চাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠন ও শিক্ষার্থীরা নানারকম সমালোচনা করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম সাম্যর বিভাগ আইইআর’র ২৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ইব্রাহিম মুন্সী। ১৬ মে সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে শাহবাগ থানা ঘেরাও কর্মসূচিতে তিনি বলেন, ‘এটি একটি নির্দলীয় কর্মসূচি। সাম্য ভাইয়ের মৃত্যুর পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এটিকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। তাদের মূল দাবি বিভিন্নজনের পদত্যাগ। কিন্তু আমাদের প্রধান এবং একমাত্র দাবি সাম্য হত্যার সঙ্গে জড়িত প্রধান আসামিসহ সকলের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার।’
সাম্য হত্যা ইস্যুতে ঢাবির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সাখাওয়াত জাকারিয়ার লেখা পোস্টটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। তিনি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেন, ‘সাম্য ভাইয়ের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে পুরো ক্যাম্পাস যখন উত্তাল, তখন হঠাৎ ছাত্রদল দাবি তুলল ঢাবির ভিসি-প্রক্টরকে পদত্যাগ করতে হবে। কেন ভাই? ক্রাইম সিন কি ক্যাম্পাসে? সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কি প্রক্টরের অধীনে?’
তবে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতা হাসিব আল ইসলাম ফেসবুক পোস্টে এ বিষয়ে সমালোচনা করে লিখেছিলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রক্টরের ব্যর্থতা আছে। সেজন্য আপনি তাদের পদত্যাগ দাবি করতে পারেন। আমিও মেট্রোর পিলারে খুনি হাসিনার গ্রাফিতি মুছে ফেলার ঘটনায় প্রক্টরের উদাসীনতার জন্য তার পদত্যাগ দাবি করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে তিনি ক্ষমা চাইলে আমরা তার প্রতি সহানুভূতি দেখাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভিসি-প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করছেন করেন, কিন্তু সাম্য ভাইয়ের লাশকে শুধু রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়ে নয়, হত্যাকারীদের গ্রেফতার এবং বিচারের দাবিও করেন। কিন্তু ছাত্রদলের পলিটিক্যাল মুভ দেখে মনে হচ্ছে ঢাবি ভিসি উনাদের মতের না হওয়ায় উনারা হয়তো সাম্যের রক্তের অপেক্ষায় ছিলেন। সাম্য ভাই শহিদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উনারা উনাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে সক্রিয় অবস্থানে আছেন।’
তবে এসব সমালোচনার পালটা জবাব দিয়েছেন ঢাবি ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। তারা বলেন, ফিতা টেনে সাম্য হত্যার স্পটকে ক্যাম্পাসের বাহিরে দেখিয়ে হত্যার বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করছে একটি মহল।’ তারা অভিযোগ তুলে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উপাচার্য ও প্রাক্টরের আমলে বিশ্ববিদ্যালয় দু’টি খুন হয়েছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ছবি ঘৃণা স্তম্ভ থেকে মুছে দেওয়া হয়েছিল। ক্যাম্পাসে বহিরাগতরা অবাধ বিচরণ করছে।’
এসব অভিযোগের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড.সাইফুদ্দিন আহমদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর চেয়ে বেশি নিরাপদ ছিল না। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিরাগত নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছি। বর্তমানে বাইরের কোনো যানবাহন ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছে না। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার জন্য প্রক্টরিয়াল টিম, আনসার ও ভলেনটিয়ার টিম ২৪ ঘণ্টা কাজ করে যাচ্ছে। এমনকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সঙ্গে আমাদের সবধরনের যাতায়াতও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আমাদের সব কাজ দৃশ্যমান। তবে শিক্ষার্থীদের এক্সপেক্টেশন অনেক বেশি। কিন্তু আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই।’
১৪ মে সাম্যের বড় ভাই শরীফুল ইসলাম শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তামিম হাওলাদার, সম্রাট মল্লিক ও পলাশ সরদারকে আদালতে পাঠায় পুলিশ। আদালত তাদের ছয়দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তদন্ত শেষে মামলার রহস্য উদঘাটনের দাবি করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পাশাপাশি আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ বিষয়ে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রহস্য উদঘাটনের দাবি করেন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী।
তবে ডিএমপির দেওয়া তথ্যকে ‘বিভ্রান্তিকর’ হিসেবে উল্লেখ করেছে ছাত্রদল। তারা বলেছে, পুলিশ বিভিন্ন অস্পষ্ট তথ্য উপস্থাপন করে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। জনগণের সামনে সত্য লুকানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে। সাম্যর ভাই শরীফুল ইসলামও অভিযোগ করেন, ‘সাম্যকে হত্যার পর পরই ঘটনাস্থল থেকে জনগণ আসামিদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। কিন্তু পরে তাদের রাজধানীর পান্থপথে হাসপাতালে গ্রেফতার দেখানো হলো কেন? প্রথমে কেন তাদের আটক না করে যেতে দেওয়া হয়েছিল?’
তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় সাধারণ জনগণ দু’জনকে আটক করে পুলিশের হাতে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে বলা হয়, ঘটনার চার ঘণ্টা পর ঘটনাস্থল থেকে সাত-আট কিলোমিটার দূরে কোনো এক হাসপাতাল থেকে সেই দুই অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়। প্রশ্ন হলো- পুলিশ পরে কেন কেন তাদের ওই হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার দেখাল?’ এখানে প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে বলা হয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার দু’জনকে পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দেয়। কোনো চাপের কারণে পুলিশ ওই দুজনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল কি না?- জানতে চান শরীফুল।
এদিকে গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) তদন্ত অফিসার আক্তার মোর্শেদ সাম্য হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত মোট ১১ জনকে আসামি হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকজনকে একাধিকবার রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে ও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। প্রতক্ষ্যদর্শী ও আসামিদের মধ্যে তিনজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ঘটনার সময় যে ছুরি ও টেজার গান ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো উদ্ধার করা আছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে একজনের জবানবন্দি ১৬৪ ধারায় রেকর্ড করা আছে। ইনকয়ারি রিপোর্টটা এখনো পাইনি। এগুলো পেলে আমরা পুলিশি রিপোর্ট দাখিল করার জন্য প্রস্তুত আছি।’
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এমনটা হয়েছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে এমনটা মনে হচ্ছে না। এমন কোনো কিছু পাওয়া যায়নি।’