Monday 30 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মামলা জট
কেউ হারাচ্ছেন ঘটি-বাটি-ভিটা, কারও তছনছ সাজানো সংসার!

রাশেদ মামুন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৩০ জুন ২০২৫ ০৮:১০

মামলা জট। ফাইল ছবি

ঢাকা: বিচারকের অভাব, বিশেষায়িত আদালতে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ না দেওয়া, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা এবং জনবলের অভাব ও দুর্বল অবকাঠামোর কারণে কমছে না মামলা জট। ফলে খরচ মেটাতে কেউ হারাচ্ছেন ঘটি-বাটি-ভিটা, কারও আবার তছনছ হচ্ছে সাজানো সংসার। এরপরও শেষ হয় না মামলা। কবে শেষ হবে তাও জানেন না কেউ। আদালতপাড়ায় এমন খবর অহরহ। তবে কম গুরুত্বপূর্ণ মামলার চেয়ে প্রয়োজনীয় বিচারে জোর দেওয়ার পরামর্শ বিশ্লেষকদের।

ছেলে কারাগার। তাই চার বছর ধরে আদালতপাড়ায় নিয়ম করে আসছেন এক মা। তার ছেলের নাম শাওন। মাদক মামলায় জেলবন্দি তিনি। ঘটনাটি ২০২১ সালের। বিয়ে করেছিলেন মাত্র ছয় মাস আগে। ভালোই কাটছিল সংসার। নিজ ঘরে খাবার খাওয়ার সময় একদিন কথা আছে বলে শাওনকে ডেকে নেন সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এরপর দুদিনেও তার কোনো সন্ধান পায়নি পরিবার। এক পর্যায়ে জানতে পারেন তিনি র‌্যাবের হাতে আটক হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আটক হওয়ায় সাজানো-গোছানো সংসারে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। মিথ্যা মামলায় শাওনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে বলে দাবি শাওনের মায়ের। ছেলের জামিন কবে হবে জানতে সম্প্রতি ঢাকার আদালতে আসেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন শাওনের স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে।

জেল থেকে কবে ছাড়া পেতে পারেন ছেলে?- মায়ের এমন প্রশ্নে আগামী মাসে সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান আইনজীবী। শাওনের আইনজীবীর দাবি, ‘উচ্চ আদালতে তার মক্কেল বেকসুর খালাস পাবেন। এ মামলার সঙ্গে জড়িত না থাকার বিষয়টিও আদালতে প্রমাণিত হবে।’ আর এসব কথা শুনে শাওনের পরিবারের সদস্যদের চোখ বেয়ে ঝরতে থাকে অশ্রু। যাওয়ার সময় আইনজীবীকে শাওনের ছেলে বলে, ‘উকিল আঙ্কেল আমার বাবাকে আর আটকে রেখ না। বাবারে একটু ছেড়ে দাও।’

শাওনের মা বিলকিস বেগম সারাবাংলার এই প্রতিবেদকে বলেন, ‘বোনের মেয়ের সঙ্গেই ছেলের বিয়ে দিই। একদিন বাড়ি থেকে আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য। পরে থানায় খোঁজাখুঁজি করেও কোনো হদিস পাইনি। দু’দিন পরে জানতে পারি শাওনকে মাদক মামলায় আটক করেছে র‌্যাব। অথচ আমার ছেলে নেশা করতো না। কিন্তু বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে দু’টি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি হেরোইন বেচাকেনার মামলা ও আরেকটি অস্ত্র মামলা। চলতি বছরের শুরুতে হেরোইনের মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ছেলে কারাগারে যাওয়ার পর থেকে ঘুম নেই। এতে শরীরে নানা অসুখ বাসা বেঁধেছে। বাবা থেকেও নাতিটা এতিমের মতো। কেননা এখন পর্যন্ত বাবার কোলে উঠতে পারেনি। এছাড়া বিধবার মতো জীবনযাপন করছেন ছেলের বউ। আমার ছেলের জামিনের জন্য আমি আদালতের কাছে প্রার্থনা করছি।’

শাওনের স্ত্রী বলেন, ‘মিথ্যা মামলায় আমার স্বামীকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। একটি মামলায় তিনি সাজাপ্রাপ্ত। এক মাস পর পর ঢাকা থেকে অনেক কষ্টে কাশিমপুর কারাগারে দেখতে যাই। জামিন হবে বলে বলে নতুন তারিখ দেওয়া হয়। কিন্তু জামিন হয় না। এজন্য কারাগারে আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছিলেন আমার স্বামী।’

একই দিন কারাগার থেকে সিএমএম আদালতে আনা স্বামীকে দেখতে আসেন রহিমা। কিন্তু মনভরে দেখতে পারেননি প্রিয়জনকে। রহিমা সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি বরিশাল। একটুভাবে থাকার জন্য ঢাকায় আসেন। ভাড়া বাসায় থাকা শুরু করেন তারা। হঠাৎ এক মামলায় তাদের ছোট্ট সংসার পুরোপুরি তছনছ হয়ে যায়। বর্তমানে ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে সেই ভাড়া বাসায় থাকেন। সংসার চালাতে অন্যের বাসায় ঝিয়ের কাজ নেন তিনি।

মাদক মামলায় ছয় বছর ধরে খুলনা জেলা কারাগারের কনডেম সেলে রয়েছেন বিকাশ চন্দ্র বিশ্বাস। নিজেকে নির্দোষ দাবি জানিয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি দিয়েছিলেন এই কয়েদি। সম্প্রতি দেশের উচ্চ আদালতে এসে স্বামীকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য তিনদিনের সুযোগ চেয়েছেন স্ত্রী রিমা বিশ্বাস।

আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে রিমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছয়বছর ধরে মিথ্যা মামলায় জেল খাটছেন আমার স্বামী। কিন্তু তিনি পুরোপুরি নির্দোষ। আমরা গরিব মানুষ। এজন্য কোনো ভালো আইনজীবী না থাকায় তার বিরুদ্ধে মামলাটি ঠিকভাবে চলেনি। তাই তিনদিনের সুযোগ দিন, আমার স্বামী নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবেন।’

তিনি বলেন, ‘‘আমার স্বামী জেল থেকে নিজের হাতে লেখা ছয় পাতার একটি চিঠি প্রধান বিচারপতির দফতরে পাঠিয়েছিলেন। তিনি নিজেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ চেয়ে লিখেছেন- ‘তিনদিন সময় দিন। যদি নির্দোষ প্রমাণ করতে না পারি, তাহলে ফাঁসি দিন।’’

চিঠিতে বিকাশ চন্দ্র লিখেছেন, ‘আমি কোনোভাবে এ মামলায় জড়িত না। একজন ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া মানে শুধু ওই ব্যক্তি নয়, তার পুরো পরিবারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া। আমি যদি আমার মামলা নিজেই শুনানি করে নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হই, তাহলে উচ্চ আদালত যেন আমাকে দ্রুত ফাঁসি কার্যকরের নির্দেশ দেন।’

সবশেষ তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত নিষ্পত্তি হওয়া ১৬৫৬টি মামলার মধ্যে ১৩৯৩টিতেই খালাস পেয়েছেন আসামিরা। বাকি ১৯৩টি মামলায় সাজা হয়েছে। আর ভিন্নভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে ৭০টি মামলার। এছাড়া তুলনামূলক গত মে মাসে নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ-হত্যা মামলায়ও সাজার হার কম ছিল। ধর্ষণের ২৮টির ২৭টিতেই খালাসের রায় এসেছে। নারী নির্যাতনের ৯৬টি মামলায়ও খালাস পেয়েছেন আসামিরা। ৯৮টি নিষ্পত্তি হওয়া মামলার দুটিতে মাত্র সাজা হয়েছে।

তদন্ত সাপেক্ষে মামলা না নেওয়া কিংবা সত্যতা না মেলায় এমন হচ্ছে বলে মনে করছেন এপিপি মনির হোসেন সুমন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমলযোগ্য হলেও অভিযোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এফআইআর নেওয়া থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরত থাকতে হবে। শুরুতে প্রাথমিক তদন্তের কাজ শেষ করা প্রয়োজন। তদন্তে সত্যতা পেলে এজাহার হিসেবে গ্রহণ করলে অনেকাংশে মামলা পরিচালনায় সহজ হয়।’

এছাড়া ‘শুরুতে আইনি প্রক্রিয়া না মানায় আদালতের রায়ে ৮৮ শতাংশ মামলায় খালাস পেয়ে যাচ্ছেন আসামিরা। অথচ প্রথমে তারাই সাজা পান। ফলে এসব মামলায় আসামির জীবনসহ তার পরিবার পথে বসার উপক্রম হয়।’ তাই মামলা পরিচালনায় আরও গবেষণা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন এই আইনজীবী।

সূত্রমতে, একশ্রেণির লোক শুধু মামলা দিয়ে অন্যকে হয়রানির জন্য প্রস্তুত থাকে। আইনকে তোয়াক্কা না করেই তারা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ব্যক্তিগত শত্রুতা বা রেষারেষির মামলা টেনে নিয়ে আসে আদালতে। ফলে কম গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিয়ে আদালতকে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। মামলাবাজদের এসব কাজে আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের পকেট ভারী হলেও নিঃস্ব হয়ে পড়েন ভুক্তভোগীরা। এ ছাড়া, ছোটখাটো ঘটনা নিয়েও একাধিক মামলা হয় আদালতে। এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষীকেও উপস্থিত করাতে পারেন না বাদীরা। ফলে বছরের পর বছর মামলা টানতে হয় বিবাদীদের।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো মামলায় সাধারণত গ্রেফতার হন নির্দিষ্ট আসামি। কিন্তু এর প্রভাব পুরো পরিবারে পড়ে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মামলার ঘানি টানতে টানতে অনেকেরেই পথে বসতে হয়। সামাজিকভাবেও কেউ কেউ হেয়প্রতিপন্ন হন। এজন্য মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের আরও সচেতন হওয়া জরুরি। সত্য-মিথ্যারও সঠিক বিবেচনা করা প্রয়োজন।

সারাবাংলা/আরএম/পিটিএম

ঘটি তছনছ ভিটা মাটি মামলা জট সাজানো সংসার