ঢাকা: ২০২৪ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহেই সারাদেশের শিক্ষাঙ্গন জুড়ে শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, পুরোনো কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল না করে একটি মেধাভিত্তিক ও বৈষম্যহীন নিয়োগব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এসব দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’র ব্যানারে কোটাবিরোধী অবস্থান সারাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
তখনও ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়কদের কমিটি ঘোষণা হয়নি। আন্দোলন দ্রুত দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ায় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সারাদেশের আন্দোলনরত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রথমে ৬৫ সদস্যবিশিষ্ট সমন্বয়ক টিম গঠন করে। যা পরবর্তী সময়ে আন্দোলন জোরদারের লক্ষ্যে বর্ধিত করা হয়েছিল।
১ জুলাই: আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে শিক্ষার্থীরা প্রথমবারের মতো সংগঠিত হয়। সকাল ১০ টা থেকেই ছোট ছোট মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে হাজারো শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হন। আন্দোলনকারীরা দাবি করেন, ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহাল করে কোটা সংস্কারের সিদ্ধান্ত বহাল রাখতে হবে এবং উচ্চ আদালতের তৎকালীন রায় যেন মেধাব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত না করে।
এক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি থেকে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জড়ো হন। এ সময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। সারজিস একে একে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, ‘আমরা কি কেউ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে? আমরা কি মনে করি না মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান? আমরা কি মনে করি না যে, তারা যুদ্ধ করেছিলেন বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে? তারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। আমরা কি মনে করি কি না, তারা সেই সময় বৈষম্যর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন? কোটাপদ্ধতি বৈষম্য কি না? আমরা বিশ্বাস করি কি না যে, মুক্তিযোদ্ধারা মনে করেন- এই কোটা বৈষম্য দূর হওয়া প্রয়োজন? ঠিক সেই কারণেই কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের এই অবস্থান।’
এ সময় উপস্থিত ছাত্র-জনতা ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ সূচক উত্তর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। একইদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন ও সমাবেশের মাধ্যমে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
২–৩ জুলাই: আন্দোলনের বিস্তার
২ জুলাই থেকে ঢাকার বাইরে আন্দোলনের পরিধি বাড়তে থাকে। ঢাকার গুণ্ডি পেরিয়ে রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একযোগে মানববন্ধন ও সড়ক অবরোধ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি থেকে রাজু ভাস্কর্য পর্যন্ত নিয়মিতই বিকেল তিনটা থেকে মিছিল বের হতে থাকে। আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে শাহাবাগ হয়ে মৎস্য ভবন এলাকা পর্যন্ত মিছিল বিস্তৃত করেন। ‘কোটা না মেধা? মেধা মেধা’, ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’- ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
৪ জুলাই: কর্মসূচি আরও জোরালো
৪ জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিতে শিক্ষার্থীরা হল থেকে বের হওয়ার সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বাধা সৃষ্টি করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের গেইট বন্ধ করে দেয় ছাত্রলীগের হল পর্যায়ের নেতারা। পরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা মিছিল নিয়ে গিয়ে হলের গেইট খুলে তাদের বের করে নিয়ে আসেন।
এক পর্যায়ে নাহিদ ইসলাম আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘এটি শুধুমাত্র একটি ছাত্র আন্দোলন নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক প্রতিরোধ।’ এদিন রাত ১২টার দিকে সারজিস আলমকে হলছাড়া করার চেষ্টার খবর ছড়িয়ে পড়ে। এই খবরে অমর একুশে হলের সামনে বিক্ষোভ শুরু হয়। এতে একুশে হলের পাশাপাশি অন্যান্য হলের শিক্ষার্থীরা যোগ দেন।
এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপ করা হয়। তখন একুশে হলের অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতারা সারজিসের কাছে ক্ষমা চান। বিক্ষোভ চলাকালে দিবাগত রাত ১টার দিকে একুশে হলের প্রাধ্যক্ষ ঘটনাস্থলে আসেন। সারজিস হলে থাকবেন বলে তিনি আশ্বস্ত করলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শান্ত হন। কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা সারজিসের সহযোগীরা তাকে তার হলের কক্ষে পৌঁছে দিয়ে আসেন।
একই দিনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে কয়েকটি স্থানে ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সামান্য হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। যদিও বড়ধরনের সহিংসতা ঘটেনি।
৫–৭ জুলাই: ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা
৫ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে নতুন কর্মসূচি চালু করা হয়। ৭ জুলাই থেকে ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে এই অবরোধ কর্মসূচি শুরু হয়। প্রথম দুদিন অর্ধদিবস অবরোধ চলার পর মঙ্গলবার বিরতি দেওয়া হয়।
এ কর্মসূচির আওতায় শিক্ষার্থীরা রাস্তা, সিগন্যাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নেন। বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘প্রত্যয়’ স্কিম বাতিলের বিষয়ে আন্দোলনের পরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাস-পরীক্ষা আগে থেকেই বন্ধ ছিল।
শাহবাগ, ফার্মগেট, প্রেস ক্লাব, সায়েন্সল্যাব, মিরপুরসহ রাজধানীর বিভিন্নস্থানে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় তাদের সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের জনগণ আন্দোলনের সমর্থন দেন। এছাড়া সামাজিক মাধ্যমে ‘#BanglaBlockade’ হ্যাশট্যাগে প্রচারণাও চালানো হয়, যা দেশব্যাপী ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।