Tuesday 15 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

১৫ জুলাই: চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের হামলা ও শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের সূচনা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৫ জুলাই ২০২৫ ০৮:৫৩ | আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৫ ১১:৩৩

সেই ১৫ জুলাই, পুলিশের সামনে দেশের পতাকা গায়ে জড়িয়ে পথে দাঁড়িয়েছিল শিশুও। ছবি: সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: সরকারি চাকরিতে কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চট্টগ্রামে জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে এসে গতি পেয়েছিল। নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনকে মূল পয়েন্ট বানিয়ে শিক্ষার্থীরা যখন মরণপণ লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন প্রথম আক্রমণটা আসে বর্তমানে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কাছ থেকে।

দিনটি ছিল ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই। সেদিন চট্টগ্রাম নগরীতে প্রথম ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। তবে শিক্ষার্থীরাও সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। পালটাপালটি সংঘাতে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছিলেন।

সেদিন বিকেল ৪টার দিকে নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনে অবস্থান নিতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফেডারেশনের নেতা ও বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম মহানগরের সমন্বয়ক আরিফ মঈনউদ্দিনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের বেসরকারি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (আইআইইউসি) শিক্ষার্থীরা সীতাকুণ্ডের ক্যাম্পাস থেকে ষোলশহরে প্রথমে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।

বিজ্ঞাপন

ছবি: সারাবাংলা

ছবি: সারাবাংলা

এর আগপর্যন্ত শাটল ট্রেনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা এসে মিছিল-সমাবেশ করে আন্দোলন এগিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু সেদিন দুপুরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেলস্টেশনে শাটল ট্রেন আটকে দেয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বাদাতা, চবি’র নাট্যকলা বিভাগের ছাত্র খান তালাত মাহমুদ রাফিকে ট্রেন থেকে নামিয়ে লাঞ্ছিত করে। এর ফলে ১৫ জুলাই চবি থেকে শিক্ষার্থীরা প্রথমদিকে কর্মসূচিতে উপস্থিত হতে পারেননি। বিকেল ৫টার মধ্যে অবশ্য অনেকে চবি থেকে ষোলশহরে এসে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন।

আরিফ মঈনউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ’শুরুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শাটল ট্রেনে শিক্ষার্থীরা আসার পর নিউমার্কেট কিংবা ষোলশহরে কিছুক্ষণ বিক্ষোভ করে কর্মসূচি শেষ করা হতো। ১১ জুলাই কিংবা ১২ জুলাই আমরা জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দিই। সেদিন আমি আন্দোলনে যারা লিড দিচ্ছিল, খান তালাত মাহমুদ রাফি ও রাসেল আহমেদ, তাদের বলি যে এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে আন্দোলন হবে না। আন্দোলন জোরদার করতে হলে শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসতে হবে। ১৪ তারিখ রাতে আমরা মিটিং করে পরদিন ষোলশহরে বড় ধরনের বিক্ষোভের কর্মসূচি ঠিক করি।’

ওইদিন বিকেলে ষোলশহর রেলস্টেশনে আইআইইউসি’র জমায়েত যখন চলছিল, ছাত্র ফেডারেশনের নেতা আরিফ মঈনউদ্দিন ও ইমন সৈয়দ তখন সেখানে যান। তারা দেখেন, সেখানে কোনো মাইক নেই। তারা উপস্থিত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা তুলে মাইক আনার ব্যবস্থা করেন। এসময় পাঁচলাইশ থানার তৎকলীন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা রেলস্টেশনে গিয়ে তাদের সেখান থেকে সরে যেতে বলেন, অন্যথায় সেখানে সংঘাত সৃষ্টি হবে বলে জানান। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যেতে অনড় থাকেন।

ছবি: সারাবাংলা

ছবি: সারাবাংলা

আরিফ মঈনউদ্দিনের ভাষ্য অনুযায়ী, রেলস্টেশনের বাইরে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) কার্যালয়ের সামনে তারা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অবস্থান দেখতে পান। সেখান থেকে তারা আন্দোলনকারীদের ‘জামায়াত-শিবির-রাজাকার’ বলে নানাভাবে কটূক্তি করতে থাকেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধের মানসিকতা নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ চালিয়ে যেতে থাকেন।

মাইক আসার পর প্রথম ফেডারেশনের নেতা ইমন সৈয়দ বক্তব্য দেন। তিনি ‘ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী’ উল্লেখ করে বক্তব্য রাখলে রাসেল তার কাছ থেকে মাইক কেড়ে নেন। রাসেলের মত ছিল, কোনো সংগঠন কিংবা কারও নাম উল্লেখ করার কারণে যাতে সংঘাতের সৃষ্টি না হয়। তবে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের আপত্তির মুখে তখন অন্যান্যরাও ছাত্রলীগের নাম উল্লেখ করে বক্তব্য দেন।

‘আমাদের সমাবেশ যখন চলছিল, তখন হঠাৎ দেখি রেলস্টেশনের সামনে কালভার্ট পার হয়ে ২০-৩০ জন সন্ত্রাসী রামদা, কিরিচ, লোহার রড, লাঠিসোঠা নিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। তারা এসেই আমাদের ওপর হামলা শুরু করে। আমরাও পালটা পাথর নিক্ষেপ করি। ধাওয়া দিয়ে একপর্যায়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের শপিং কমপ্লেক্সের পাশের গলি এবং জিইসি মোড়ের দিকে চলে যেতে বাধ্য করি। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। তবে তারা বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে কয়েক রাউন্ড ফায়ার করে। ককটেলও মারে।’

ছবি: সারাবাংলা

 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৎকালীন সরকারি সিটি কলেজ শাখার সমন্বয়ক নিজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে জানান, ছাত্রলীগের হামলায় সেদিন অন্তঃত পাঁচজন শিক্ষার্থী আহত হন। এদের মধ্যে দুজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে এর মধ্যেও তারা বিক্ষোভ সমাবেশ শেষ করে সেদিনের মতো ফিরে যান।

সেদিনের পালটাপালটি সংঘাতে দুজন সাংবাদিকও আহত হয়েছিলেন। এরা হলেন- সারাবাংলার আলোকচিত্রী শ্যামল নন্দী ও দীপ্ত টেলিভিশনের ব্যুরো প্রধান রুনা আনসারি। এছাড়া সেদিন ছাত্রলীগকে প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিশু-কিশোর, পথচারী এমন অনেক সাধারণ লোকজনকেও যোগ দিতে দেখা গিয়েছিল।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম মহানগরের সমন্বয়ক আরিফ মঈনউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছাত্র। কিন্তু সেসময় ক্যাম্পাসে ছাত্র ফেডারেশনের ব্যানারে বিভিন্ন আন্দোলনে লিড দেওয়ার কারণে ছাত্রলীগের রোষানলে পড়েছিলাম। সেজন্য ক্যাম্পাসে যেতে পারতাম না। কিন্তু ১৫ জুলাই রাফিকে শাটল ট্রেন থেকে নামিয়ে যেভাবে ছাত্রলীগের নেতারা মারধর করে এবং তাদের সঙ্গে মিছিলে নিয়ে তুমি কে-আমি কে, বাঙালি বাঙালি এ স্লোগান দিতে বাধ্য করে।’

‘এ খবর পৌঁছার পর আমরা আর স্থির থাকতে পারিনি। ছাত্রলীগকে প্রতিরোধ করার শপথ নিয়েছিলাম। ১৫ জুলাই চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ যেমন আমাদের ওপর হামলা শুরু করে, একইভাবে ছাত্রলীগকে প্রতিরোধের সূচনাও সেদিন শুরু হয়েছিল।’

ছবি: সারাবাংলা

সারাবাংলা/আরডি/এসডব্লিউ

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর