চট্টগ্রাম ব্যুরো: কাঠের আসবাব তৈরির দোকানের একেবারে ছা-পোষা একজন কর্মী ছিলেন মো. ফারুক। চট্টগ্রাম শহরে পাহাড়ের ঢালুতে একটি ছোট্ট খুপড়ি ঘর ভাড়া নিয়ে স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে থাকতেন। সংসারে অভাব ছিল, কিন্তু মাসে এনে মাসে খাওয়া অল্পশিক্ষিত ফারুক ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার লড়াইয়ে ছিলেন। আর এ জীবন সংগ্রামের মধ্যেই নিজেদের সুখ খুঁজে নিয়েছিলেন ফারুক ও তার স্ত্রী-সন্তানেরা।
কিন্তু কে জানতো এক ঝড় এসে তাদের সেই সুখের পৃথিবীকে লণ্ডভণ্ড করে দেবে! সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলনের শুরতে চট্টগ্রামে যখন লাশ পড়া শুরু হলো গত বছরের ১৬ জুলাই, তার প্রথম শিকার তিনজনের একজন ফারুক। দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে মধ্যরাতে স্ত্রী-সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য কেনা পণ্যের ব্যাগ হাতে নিত্য ফেরা মানুষটির যাত্রা থেমে গেল নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ-যুবলীগ, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের মাত্র দু’টি গুলিতে।
এখন ফারুক নেই, শহরের লালখান বাজারে পাহাড়ের ঢালুতে সেই পর্ণকুটিরে আছেন তার স্ত্রী সীমা আক্তার, ছেলে অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া ফাহিমুল ইসলাম আর মেয়ে সদ্য বিদ্যালয়ের সীমানায় পা দেওয়া শিশু ফারিয়া আক্তার। ফারুক চলে গিয়ে সীমাকে চোখেমুখে দিয়ে গেছে অসীম অন্ধকার, কীভাবে দুই ছেলেকে মানুষ করবেন, কীভাবে তাদের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত তুলে দেবেন ! রাতে ঘুমোতে গিয়ে চোখের জলে ভিজে বালিশ, কখনও সন্তানদের আড়ালে, কখনও-বা সন্তানেরা তাকে আড়াল করে।
সম্প্রতি সারাবাংলা’র কাছে স্বামী হারানোর দিনটির দগদগে স্মৃতি তুলে ধরেন সীমা আক্তার। সেদিন সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে চলে যান সীমা। বাসায় ছেলেকে নিয়ে নাস্তা খেয়ে সাড়ে ৮টার দিকে দোকানের উদ্দেশে বের হন ফারুক। ছেলে চলে যায় কোচিংয়ে।
সীমা বলেন, ‘মেয়েকে নিয়ে স্কুল থেকে ফেরার পর সেদিন আমার খুব ক্লান্ত লাগছিল। প্রতিদিন আমি দুপুরে ফোন দিই, কিন্তু সেদিন দিইনি। বিকেল ৩টার দিকে উনার (ফারুক) মালিক আমার বাসায় এসে বলেন, ফারুক গুলি খেয়েছে, মেডিকেলে আছে। আমি তাড়াতাড়ি মেডিকেলে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি, আমার হাজবেন্ডকে একটা টুলের মধ্যে শুইয়ে রেখেছে। পুলিশ বলল, উনি মারা গেছেন।’
‘আমার হাজবেন্ড দুপুরের খাবার বাসা থেকে কখনও নিয়ে যেত না, হোটেলে খেত। দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য দোকান থেকে বের হয়েছিল। ভাত খেয়ে আবার দোকানে যাবার সময় তাকে গুলি করে হত্যা করে। দুইটা গুলি করেছে, নির্মমভাবে হত্যা করেছে। একটা মানুষকে মারতে কতটা গুলি লাগে ? পুলিশ বলেছে- এগুলো আমাদের গুলি ছিল না, ছাত্রলীগের গুলি ছিল।’
তিনি জানান, ভোর ৬টার মধ্যে ময়নাতদন্ত শেষ করে ফারুকের লাশ পুলিশ পাহারায় নেওয়া হয় কুমিল্লার চান্দিনায় শ্বশুরবাড়িতে। সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। পুলিশের চাপে মাত্র আধাঘণ্টার মধ্যে দাফন সারতে হয়েছে।
শহিদ ফারুকের ১৪ বছর বয়সী ছেলে ফাহিমুল ইসলাম বলেন, ‘আমার আব্বুর লাশটা একটু ছুঁয়েও দেখতে পারিনি। মুখটাও ভালোভাবে দেখতে পারিনি। পুলিশ ছিল, আমাদের দেখতে দেয়নি। তাড়াতাড়ি করে আধাঘণ্টার মধ্যে লাশ কবর দিয়েছে।’
বাবার স্মৃতি তুলে ধরে কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি প্রতি রাতে আব্বুর সাথে ঘুমাতাম। আব্বু ছিল আমার বালিশ। সেই বালিশে মাথা রেখে, জড়িয়ে ধরে আমি সারারাত ঘুমাতাম। আমার সেই বালিশটা আজ আর নেই। আব্বু সবসময় পড়ালেখার করতে বলতেন। পড়ালেখা করব ভালোভাবে। ভালো একজন মানুষ হওয়ার চেষ্টা করব।’
ফারুকের ৮ বছর বয়সী মেয়ে ফারিয়া বলেন, ‘আব্বু প্রতি রাতে বাসায় ফিরে আমার হাতে টাকা দিতেন। সেটা খুব মনে পড়ে।’
দুই সন্তানকে পাশে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সীমা বলেন, ‘আমার স্বামী তো কোনো রাজনীতিতে ছিল না, কোনো দল করতো না। কোনোদিন চায়ের দোকানে গিয়েও আড্ডা দিতো না। অথচ সে বেশি চা খেত। আমি বাসায় বারবার চা বানিয়ে দিতাম। আজ আমার চা খাওয়ার লোকটা আর নেই। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমাদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত এখন কান্নার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমার ছেলে বলে- আম্মু, আমার আব্বু তো আর কোনোদিন আসবে না। আমার মেয়ে রাতে অনেক কান্না করে।’
স্বজন হারিয়ে দিনযাপনের দুঃখগাঁথা তুলে ধরেন সীমা আক্তার। জানালেন, স্বামীহারা সীমাকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনারের অনুরোধে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আউটসোর্সিংয়ের ভিত্তিতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর একটি চাকরি দিয়েছেন।
সীমা আক্তার বলেন, ‘বেতন যা পাই, বাসা ভাড়া সাড়ে ৪ হাজার টাকা দিতেই চলে যায়। কীভাবে পেটে ভাত দেব, কীভাবে ছেলে-মেয়ের স্কুল আর কোচিংয়ের বেতন দেব ! আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমাদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত এখন কান্নার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমার ছেলে বলে- আম্মু, আমার আব্বু তো আর কোনোদিন আসবে না। আমার মেয়ে রাতে অনেক কান্না করে।‘
তিনি জানান, সরকারিভাবে পাওয়া ১০ লাখ টাকা ভাতার মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা ফারুকের বাবাকে দেওয়া হয়েছে। লাশ দাফনের জন্য জেলা প্রশাসন এক লাখ টাকা দিয়েছিল, সেই টাকাও তার শ্বশুর আত্মসাতের চেষ্টা করেছিলেন। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাওয়া পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে এক লাখ টাকা শ্বশুরকে দেওয়া হয়েছে।
সীমার অভিযোগ, টাকা ভাগ করে নিয়ে গেলেও তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কোনো সহযোগিতা তারা পাচ্ছেন না। বরং ফারুক হত্যা মামলার বাদী হিসেবে তার বাবা আসামি নিয়ে বাণিজ্য করছেন।
তিনি বলেন, ‘আজ স্বামী হারিয়েছি এক বছর, আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাদের খবরও নেয় না। আমিও আর তাদের কাছে যাই না। প্রয়োজনে ভিক্ষা করে খাব, কিন্তু তাদের কাছে যাব না। সরকার যে টাকা দিচ্ছে, সেটা তো আমার এতিম বাচ্চাদের হক। আমার শ্বশুরের আরও পাঁচটা ছেলে আছে। তারা সবাই ইনকাম করে। তাহলে আমার সন্তানের হক কেন তিনি নিচ্ছেন? সরকারের কাছে অনুরোধ, আমার এতিম বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে তাদের হক যেন আর কাউকে না দেয়। টাকাগুলো যদি আমি পাই, তাহলে আমার ছেলে-মেয়েদের মানুষ করতে পারব।’
‘আমার শ্বশুরবাড়ি নোয়াখালী, সেখানে কোনো ভিটেমাটি নেই। আমাদের কোনো মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। আমি বিধবা একটা মহিলা, দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে কীভাবে চলছি, সেটা আমার শ্বশুর একবারও চিন্তা করছেন না।’
ফারুক হত্যা মামলায় প্রসঙ্গে সীমা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীকে কারা মেরেছে, আমি তো নিজের চোখে দেখিনি। দেখলে তো আমি নিজেই মামলা করতাম। এখন দেখি নাই যখন, আমি তো পুরো বাংলাদেশের মানুষের নামে মামলা দিতে পারি না। কিন্তু আমার শ্বশুর মামলা করেছে। উনাকে শুধু সাইন করতে বলেছে। ২৬৯ জনের নামে মামলা দিয়েছে, অজ্ঞাত রেখেছে আরও ৪০-৫০ জন। এগুলো নিয়ে এখন আমার শ্বশুর বাণিজ্য করছেন। উনার সঙ্গে আরও লোক জুটেছেন। মামলার আসামি অনেক নিরীহ-গরীব লোক, তাদের আসামির তালিকা থেকে বাদ দেবে বলে টাকা খাচ্ছে।’
‘আমার শ্বশুর যদি সন্তানের বিচার চাইতো সত্যিই, তাহলে উনি কী এ কাজ করতেন ! যেখানে নিজের ঘরেই শত্রু, এখন বিচারের আমি কোনো আশাই দেখি না। বিচার করলে আল্লাহ করবে। বিচার কী হচ্ছে, না হচ্ছে আমি কিছুই জানি না, যেহেতু আমি মামলার বাদী না। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বের করে আসামি কর, এত লোককে আসামি করে মামলা হবে কেন। তাহলে তো বিচারটা সহজে পেতাম।’
এ সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদ ফারুকের বাবা মোহাম্মদ দুলাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকার যে টাকা-পয়সা দিচ্ছে, বাবা হিসেবে আমারও তো হক আছে। সেজন্যই তো সরকার আমাকেও টাকার ভাগ দিচ্ছে। প্রথমে পাঁচ লাখ টাকা থেকে আমাকে এক লাখ টাকা দিয়েছে। এরপর ১০ লাখ টাকা থেকে আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা যখন আমার ছেলের বৌকে ডেকে সাড়ে ১০ লাখ টাকা দিয়েছিল, সেখানে তো আমি কোনো ভাগ চাইনি। জামায়াত ইসলামী চার লাখ টাকা দিয়েছে, সেটাও ফারুকের বৌ পেয়েছে।’
মামলা বাণিজ্যের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এগুলো মিথ্যা কথা। কোনো প্রমাণ নেই।’
সীমা আর তার ছেলের এখন চাওয়া তাদের সঠিক পুনর্বাসন আর হত্যার বিচার। জুলাই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে শহীদদের স্বীকৃতিও প্রত্যাশা করছেন ফারুকের স্ত্রী।
নির্বাচনের আগেই এসব দাবি পূরণের প্রত্যাশা জানিয়ে সীমা আক্তার বলেন, ‘প্রতিটি শহিদ পরিবার, আহতদের পুনর্বাসন করা হোক। সন্তানদের পড়ালেখা রাষ্ট্রীয় খরচে হোক। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে, জুলাইয়ের শহিদদেরও দেওয়া হোক। আমরা এগুলো বারবার বলছি, কিন্তু এক বছর হয়ে যাচ্ছে, কিছুই হচ্ছে না। নির্বাচন নির্বাচন করে আমাদের এসব থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।’
‘জুলাই ঘোষণাপত্রটা হলে আমরা একটা স্বীকৃতি পেতাম। এই সরকারকেই এগুলো করতে হবে। যে সরকার শহিদদের রক্তের ওপর দিয়ে গঠন হয়েছে, তারা যদি করে না যায়, তাহলে পরে নির্বাচনে জামায়াত আসুক, এনসিপি আসুক, বিএনপি আসুক, তারা করবে কী না আমরা তো জানি না। জুলাইয়ের যে হত্যাকাণ্ড, হত্যাকারীদের বিচার করা দরকার। তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে শহিদদের পরিবারকে দেওয়া হোক।’
ছেলে ফাহিমুল বলেন, ‘শেখ হাসিনার লোকজন গুলি করে আমার আব্বুকে মেরে ফেলেছে। আমি বিচার চাই। যারা আমার আব্বুকে মেরেছে, তাদের বিচার হোক।’
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে স্বামীহারা সীমা আলাপের ইতি টানেন এভাবে, ‘যে মানুষটা চলে গেছে, সেটা তো আর ফিরবে না। আমি মরণের আগপর্যন্ত স্বামী হারানোর আর আমার সন্তানদের বাবা হারানোর অভাবটা আর পূরণ হবে না।’