ঢাকা: ২২ জুলাই ২০২৪। ২১ জুলাইয়ের রাত তখনও শেষ হয়নি। ঢাকার আকাশে তখনও ধোঁয়া, আতঙ্ক আর হেলিকপ্টারের ঘনঘন গর্জন। মধ্যরাত পেরিয়ে গেলেই শুরু হয় ‘চিরুনি অভিযান’— এক ভয়াল প্রহর। যেটি কেবল একটি রাজনৈতিক অভিযান ছিল না, ছিল একটি সমাজ-মনস্তত্ত্বের নিরীক্ষা। ২২ জুলাই ভোর যেন ইতিহাসের পাতায় একটা গভীর ক্ষত। যে ক্ষত আজও অনেকের স্মৃতিতে জীবন্ত।
২২ জুলাই ভোরে বাসার বাইরে হঠাৎ গাড়ির শব্দ
গুলিস্তান, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, ধানমণ্ডি— ঢাকার এরকম অনেক এলাকায় একেক পরিবারের রাত ভাঙে দরজায় কড়া নাড়ার ধাক্কায়। মাত্র ছয় ঘণ্টায় রাজধানী থেকে গ্রেফতার করা হয় ৫১৬ কিশোর-তরুণকে। এ নিয়ে ছয় দিনে (১৭ থেকে ২২ জুলাই) সারাদেশে গ্রেফতারের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে যায়। তাদের অনেকে তখনও বোঝেনি কেন, কী কারণে, এবং কোন আইনের অধীনে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
দেশব্যাপী গ্রেফতার অভিযান
এই অভিযানের প্রভাব শুধু রাজধানীতে সীমাবদ্ধ ছিল না। চট্টগ্রামে গ্রেফতার হয় ৪৬ জন, গাজীপুরে ১৫৬ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে ২৫ জন, কুমিল্লায় ৯১ জন, ফেনীতে ৮ জন। এমনকি গাইবান্ধায় দু’টি নাশকতা মামলায় ৪৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
আরও শক্ত অ্যাকশন
২২ জুলাই এর আগের দিন রাতেই সিদ্ধান্ত হয় ‘আরও শক্ত অ্যাকশন’। এদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কোটা-সংক্রান্ত সারসংক্ষেপে সই করেন। একইদিন বিকেলে তিনি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার কথা জানান।
সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সে সময় চার দফা দাবি দিয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত করেন। কিন্তু তা-ও সামগ্রিক সহিংসতা ঠেকাতে পারেনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই ২২ জুলাই পর্যন্ত ৬৮ জন নিহত ছাত্র-তরুণের লাশ হস্তান্তর করা হয় পরিবারগুলোর কাছে। হাসপাতালের মর্গ যেন আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসের নীরব দলিল হয়ে ওঠে।
কারফিউ, নির্বাসন ও শূন্যতা
১৯ জুলাই মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া কারফিউয়ের তৃতীয় দিন ছিল ২২ জুলাই। সেদিন দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়। এই সময়েই অনেকে খাবার কিনতে, স্বজন খুঁজতে বা শুধু একটু আলো-বাতাস পেতে বাইরে বের হয়। কিন্তু সর্বত্রই ছিল সেনাটহল, র্যাবের হেলিকপ্টার ও আতঙ্কের সাঁজোয়া উপস্থিতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা রাশেদ আল মাহমুদ সেদিন সন্ধ্যায় বলেছিলেন, ‘এটা কেবল কোটা সংস্কারের আন্দোলন নয়। এটা ছিল অস্তিত্বের প্রশ্ন, গায়ের উপর দাগ কেটে লেখা- অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না।’
রাষ্ট্রীয় ভাষ্য বনাম বাস্তব স্মৃতি
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘পরিস্থিতির আরও উন্নতির জন্য কারফিউ অব্যাহত থাকবে।’ আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ঘোষণা দেন, ‘পাই পাই করে হিসাব দিতে হবে।’ সেনাপ্রধান যাত্রাবাড়ীসহ ঢাকা মহানগরীর বিভিন্নস্থানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মোতায়েন করা সেনা সদস্যদের কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। এ সময় সেনাপ্রধান বলেন, ‘জনগণের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের যেকোনো প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী কাজ করে যাচ্ছে।’
এদিন সারাদেশে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীসহ ১ হাজার ২০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পঞ্চম দিনের মতো পুরো দেশকে ইন্টারনেটবিহীন রাখে সরকার। এক নির্বাহী আদেশে সাধারণ ছুটি আরও একদিন (২৩ জুলাই) বাড়ানো হয়।
সমাপ্তি নয়, স্মরণ
২২ জুলাইয়ের চিরুনি অভিযান কোনো অধ্যায়ের সমাপ্তি নয়, বরং এক নতুন প্রশ্নের শুরু হয়েছিল। রাষ্ট্র, নাগরিক অধিকার, ছাত্র রাজনীতি এবং প্রতিবাদের ভাষা— সবকিছুর মানে যেন সেদিন নতুন করে লিখে গিয়েছিল সেই প্রহর।