ঢাকা: এবিএম খায়রুল হক এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। আইন কিংবা রাজনৈতিক অঙ্গনেও আলোচনার নয়া খোরাক। কেননা শত চেষ্টা করেও গ্রেফতার এড়াতে পারেননি নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসকারী সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। তার কারণেই নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেননি মানুষ। নিজের স্বার্থে দেশকে ঠেলে দেন সংঘাত আর সংকটের পথে। অবশেষে তার গ্রেফতারে বিচারিক অঙ্গনে নেমে এসেছে একধরনের স্বস্তি। তার দৃষ্টান্তমূলত শাস্তি চেয়েছেন আইনজ্ঞরাও।
বিচারপতি খায়রুল হকের গ্রেফতারের খবর চাউর হতেই একে একে বেরিয়ে আসে তার সব অপকর্মের কথা। তার কঠিন শাস্তি চেয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে কর্মরত আইনজীবীরা। বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীরাও হয়েছেন একাট্টা। খায়রুল হককে গণতন্ত্র হত্যার মূল কারিগর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল।
এক প্রতিক্রিয়ায় কায়সার কামাল বলেন, ‘দুর্ভাগ্যক্রমে বিচার বিভাগে খায়রুল হককে পেয়েছিলেন দেশের মানুষ। যিনি মোর ক্যাথলিক দেন পোপ তথা শেখ হাসিনার চেয়ে বড় আওয়ামী লীগার ছিলেন এই অবিচারক খায়রুল। তাকে জ্ঞানপাপী হিসেবেই চেনেন মানুষ। কেননা সুপ্রিম কোর্টের মতো পবিত্র জায়গায় চেয়ারে বসে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করেছেন। এরপরের ইতিহাস সবারই জানা।’
তিনি বলেন, ‘খায়রুল হকের এমন বিচার হওয়া উচিত, যেন ভবিষ্যতে বিচারাঙ্গনে আর কোনো খায়রুলের জন্ম না হয়। তবে বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর গাফিলতি বা অনিচ্ছার কারণে দীর্ঘদিনেও খায়রুল গ্রেফতার হননি। এ নিয়ে আমরা অনেক কর্মসূচি পালন করেছি। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে তার গ্রেফতারে আইনজীবী সমাজ আশান্বিত। বিচার কার্যকর হলেই আমরা সন্তুষ্ট হবো।’
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালে খায়রুল হকের বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করছেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। তিনি বলেন, ‘খায়রুল হক সেই প্রধান বিচারপতি, যার কারণে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি দেশের ১৮ কোটি মানুষ। তার কর্মকালীনে বিচারিক জীবনে আর্তনাদ শুরু হয়। তার বেশ কয়েকটি রায়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ ছাড়া, তার রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় গেল ১৫-১৬ বছরে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হয়নি। বিনা ভোটেই সংসদে গিয়েছেন আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীরা।’
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘গত ১৫-১৬ বছরে বাংলাদেশে হওয়া অরাজকতা-হত্যা, খুন-গুম, মিথ্যা মামলা বা ভোটে কারচুপি- এসব কিছুর জন্যই খায়রুল হক দায়ী। এ ছাড়া, রাষ্ট্রীয় খরচে চিকিৎসার নামে বিভিন্ন সময়ে বিদেশে যেতেন এবিএম খায়রুল। এসব খরচ দেওয়া হতো সুপ্রিম কোর্ট ফান্ড বা সরকারের তহবিল থেকে। মূলত বিতর্কিত রায়ের কারণেই তিনি আওয়ামী লীগের কাছ থেকে এসব সুবিধা নিতেন। আর আজ তার বিচারই করবে জনতার আদালত। খায়রুল হক একজন ব্যক্তিত্বহীন। তিনি বিচার অঙ্গন ও সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।’
আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘নিজের কর্মের কারণেই খায়রুল হক গ্রেফতার হয়েছেন। তবে এ গ্রেফতার বিচারাঙ্গনের জন্য ভালো কোনো খবর নয়। জাতির জন্য এটা দুঃখজনক সংবাদ। দেশের প্রধান বিচারপতি যারা থাকেন, তাদের মান-ইজ্জতের সঙ্গে দেশের মান-ইজ্জত জড়িত। তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জাতীয় ভাবমূর্তি জড়িত। যখন কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তখন এর মাধ্যমে বিচার বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
তিনি বলেন, ‘অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না বলে শপথ নেন বিচারকরা। কিন্তু বিচারপতি খায়রুল হক এসবের তোয়াক্কা করেননি। নিজের স্বার্থ হাসিলে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছেন। নিজে বিচারপতি থাকতে একরকম আদেশ দিলেও পূর্ণাঙ্গ রায়ে পরিবর্তন করে ফেলেছেন। অথচ তখন তিনি বিচারপতির আসনে ছিলেন না। এর মাধ্যমে তিনি জুডিশিয়ালি ফ্রড করেছেন। তবে আমরা এমন কিছু আর বিচার বিভাগে চাই না। কেননা বিচারপতির সেই রায়ের কারণে দেশে ১৬ বছর ধরে আগুন জ্বলছে।’
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘খায়রুলের হকের কারণেই দেশে নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে। নির্বাচন পদ্ধতিও পুরোপুরি ধ্বংস। তার প্রতারণার জন্যই জাতিকে এসব বহন করতে হয়েছে। এজন্য বিচার হবে আইন অনুযায়ী। আইনের বাইরে করা যাবে না। যে আইনে তিনি দোষী সাব্যস্ত হবেন, সেই আইনেই তাকে বিচার করতে হবে। এক্ষেত্রে যেন আবার অবিচার না সেটিও খেয়াল রাখতে হবে।’
খায়রুল হকই বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের করে দিয়েছিলেন বলে দাবি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীনের। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের এই সভাপতি বলেন, ‘বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর সেদিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন- আমি কার কাছে বিচার চাইব। এখানে আমার সংসার। শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মৃতি জড়িত। এখান থেকে আমাকে এক কাপড়ে বের করে দেওয়া হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘খায়রুল হকের কারণে দেশের একটি নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়নি। তার কারণে দেশে আয়নাঘর হয়েছে। খালি হয়েছে হাজারও মায়ের কোল। লাখও অবৈধ মামলা হয়েছে তার কারণে। তিনি শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিয়েও কটাক্ষ করেছেন। তবে জিয়া পরিবারের ওপর যারাই হাত দিয়েছে, তাদেরই হাত পুড়ে গিয়েছে। যার প্রমাণ স্বৈরাচার হাসিনার বিদায়।’
সরকারপ্রধানের উদ্দেশে জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেন, ‘অনতিবিলম্বে সবকিছুর আগে খায়রুলের হকের বিচার করতে হবে। বিচার এমনভাবে করতে হবে, যেন জনতা বুঝতে পারে- এ দেশে অবিচার বা বিচার বিভাগকে ধ্বংস করলে কী হয়। ভবিষ্যতেও বিচারপতিরা সাবধান হয়ে যাবেন। এ ছাড়া, তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে। যেন মানুষ মনে করে এই আদালত হলো জনতার আদালত।’
খায়রুলের বিচার শুধু আইনজীবীরাই নন, দেশের ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলের নেতারাই দাবি তুলেছেন। এরই মধ্যে তার কঠিন শাস্তি চেয়ছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পিছিয়ে থাকেননি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানও। কেননা খায়রুল হকই দেশের বিচার বিভাগকে দলীয়করণের শুরুটা করে দিয়েছিলেন। নিজেকে লর্ড ড্যানিং ভাবলেও পদে পদে করে গেছেন অনিয়ম। কলমের খোঁচায় রায় ঘুরিয়ে দেওয়াই ছিল তার প্রধান কাজ। আর এসব করতেন শুধুমাত্র শেখ হাসিনাকে খুশি করার জন্য।
খায়রুল হকের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে বেশ কিছু মামলা হয়েছে। গত বছরের ১৮ আগস্ট তার বিরুদ্ধে মামলা করেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য ইমরুল হাসান। তার বিরুদ্ধে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তন ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়। ২৮ আগস্ট দুর্নীতি ও রায় জালিয়াতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেন আরেক আইনজীবী। এছাড়া ২৫ আগস্ট একই ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় আরেকটি মামলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ জুলাই সকালে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার নিজ বাসা থেকে খায়রুলকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ।