ঢাকা: ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। আগের দিন রাতেই লং মার্চ টু ঢাকা একদিন এগিয়ে আনা হয়। মার্চ টু ঢাকা ঠেকাতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্যরা প্রস্তুত রাত থেকেই। ঢাকার সব প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত বাইরের জেলাগুলো থেকে কোনো যানবাহন ঢুকতে পারেনি ঢাকায়। ফলে পুরো রাজধানী যেন এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। রাস্তাঘাট ফাঁকা, কী হবে আর কী হতে চলেছে এরকম নানান শঙ্কায় সবাই বাসায় অবস্থান করছে।
ভোর ৬টার দিকে রাজধানীর বেশ কয়েকটি সড়ক ঘুরে দেখা যায়, সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। কোথাও কেউ নেই, চলছে না যানবাহনও। কিছুদুর পর পর দেখা মেলে জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া লোকদের সঙ্গে। সড়কের মোড়ে মোড়ে দেখা মেলে পুলিশ আর সেনাবাহিনীর সশস্ত্র পাহারা।
ওই দিন সকাল ৮টা। রংপুর থেকে একজন সোর্স ফোন করেন। বলেন, ‘কী অবস্থা ঢাকার’। বলা হলো, ‘কোথাও কেউ নেই’। উত্তরে বললেন, ‘ধেয়ে আসছে জনতার স্রোত। যাত্রাবাড়ী শনিরআখড়া থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত কয়েক লাখ মানুষ ঢাকায় প্রবেশ শুরু করেছে। একই অবস্থা টঙ্গী-আব্দুল্লাহপুর এলাকাতেও। সেখানেও ঢাকায় প্রবেশের অপেক্ষায় কয়েক লাখ মানুষ। একবার বিশ্বাস হয়, আবার নীরবতায় বিশ্বাস কমে আসে।
ফোন করা হলো এক সোর্সকে, যিনি সাভারে থাকেন। তিনি বললেন, ‘সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে জনগণের পক্ষে থাকার। কেউ গুলি চালাবে না। ছাত্র-জনতার পাশে থাকবে সেনাবাহিনী। এরই মধ্যে নিউজরুম থেকে ফোন করে জানালো, ঢাকা ফাঁকাসংক্রান্ত নিউজ দিতে। তাই দেওয়া হলো।’
সকাল ৯টার দিকে রংপুর থেকে সেই সোর্স ফের ফোন করলেন। বললেন, ‘শেখ হাসিনা পালাবে। একটু পর হাসিনাকে পাওয়া যাবে না।’ এখান থেকে বলা হলো, এরকম হতেই পারে না। কারণ, পুরো ঢাকা প্রশাসনের দখলে। তখন তিনি বললেন, ‘প্রস্তুত হয়েছে। একটু পর চলে যাবে দিল্লিতে। অনেক মন্ত্রী-এমপি এরই মধ্যে দেশ ছেড়েছেন। গতকাল (৪ আগস্ট) অনেকেই চলে গেছেন।’ ওই সোর্স সবকিছুই জানতেন। কারণ, তার কাছের লোকজন সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা।
তার তথ্য যাচাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যাত্রাবাড়ীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের সড়কের ওপরে একটি ১০ তলা ভবনে বাস করা একজন সোর্স জানালেন, ‘জনস্রোত দেখা যাচ্ছে। যারা রাজধানীতে প্রবেশের জন্য আসছে। কিন্তু পুলিশ ও আর্মি প্রস্তুত রয়েছে। মনে হচ্ছে, এখানে ম্যাসাকার টাইপের কিছু ঘটে যাবে।’
১০ টার দিকে রংপুরের সেই সোর্স ফোন করে জানালেন, আলহামদুলিল্লাহ শেখ হাসিনা পালিয়েছে। ভারতে পালিয়েছে। একটি ছবি ও ভিডিও পাঠিয়ে বলে এই নাও পালানোর দৃশ্য। সঙ্গে সঙ্গে অফিসকে জানিয়েও কোনো কাজ হয়নি। কারণ, ওইদিন এই তথ্য বিশ্বাস করার মতো কেউ ছিল না। তাছাড়া সোর্সের দেওয়া তথ্য যাচাই করার মতো কোনো অপশন ছিল না।
এর পর আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপি প্রথম শেখ হাসিনা পালানোর খবর প্রকাশ করে। এএফপির বরাত দিয়ে বাংলাদেশে প্রথম আলো পালানোর সংবাদ দেয়। দুপুর ১২টার দিকে সবাই জানাজানি হয়, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়েছে। যদিও অনেকে বলছিলেন, শেখ হাসিনা বেলারুশে গেছেন। কেউ বলেছেন, বেলারুশ থেকে লন্ডনে যাবেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ভারতের দিল্লিতে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
দুপুর ১টার দিকে ঘোষণা আসে সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। সবার ধারণা ছিল, ২০০৭ সালের মতো এবারও সেনাশাসন আসছে। তবে পরবর্তী সময়ে সেনাকুঞ্জে দেখা গেলো, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের ডেকে আলাপ-আলোচনা করে বঙ্গভবনে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই ঘোষণা অনুযায়ী, ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
এর আগে, ৫ আগস্ট সকালের দিকে সেনাপ্রধানের ভাষণের কথা শুনে উত্তরা দিয়ে জনস্রোত প্রবেশ করতে থাকে ঢাকায়। যাত্রাবাড়ী দিয়েও লাখো জনতা স্রোতের মতো প্রবেশ করে। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়েছে এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ঢাকাবাসী সড়কে নেমে আসে। আবালবৃদ্ধবণিতা অলিগলি আর সড়কে উল্লাসে মাতে। খুশিতে উদযাপন করে ১৫ বছরের অপশাসনের গ্লানি। সবাই মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে থাকে। কেউ গণভবনে গিয়ে সিজদায় নত হয়। স্বৈরাচার পালানোর খুশিতে গণভবনের সম্পদ যেন অনেকে নিজের করে নেয়। যে যা পারে তাই স্মৃতি হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যায়। পরে অবশ্য অনেকেই গণভবনের অনেককিছু ফেরত দিয়ে গেছে।
৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতনের মাধ্যমে দেশ ফ্যাসিস্টমুক্ত হয়। তবে ঝড়ে যায় সহস্রাধিক প্রাণ। আহত হন অন্তত ত্রিশ হাজার মানুষ। স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন শুরু হয় ২০২৪ সালের ১ জুন। আর শেষ হয় ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বধীন সরকার পতনের মধ্য দিয়ে। যা ছিল দীর্ঘ ৩৬ দিনের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল।
২০২৪ সালের ১ জুলাই শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন। ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলন থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের রাজাকারের ‘নাতি-পুতিরা সম্বোধন করলে ওইদিন রাতে ফুসে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। স্লোগান ওঠে- তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’
১৫ জুলাই সকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগকে ডেকে স্বঘোষিত রাজাকার শিক্ষার্থীদের মোকাবিলার নির্দেশ দেন। এরপর বেলা ১০টার দিকে ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের বেধরক পেটানো শুরু করে। এ সময় অনেকে আহত হন। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে বিদেশে, ছড়িয়ে পড়ে তীব্র আন্দোলন।
১৬ জুলাই আন্দোলন তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হয়। এদিন পুলিশের গুলিতে প্রাণ ঝড়ে চার জনের। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ইংরেজি বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। বুক পেতে দিলে পুলিশ খুব কাছ থেকে গুলি করার এই দৃশ্য ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর পরই ক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ মানুষ। ব্যাপক আন্দোলন সামলাতে না পেরে ১৯ জুলাই রাতে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। জারি করা হয় রাত্রিকালীন কারফিউ। কারফিউ ভেঙে ছাত্র জনতা বিক্ষোভ করলে পুলিশ বিজিবির গুলিতে প্রাণ ঝড়তেই থাকে।
এর মধ্যে শীর্ষ সমন্বয়কদের তিনজনকে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা সংস্থা। ব্যাপক নির্যাতন করে পরে তাদের ফেলেও দিয়ে যায়। এরপর ডিবি পুলিশ আবারও ৫ সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে যায়। এতেও আন্দোলন থামে না। ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে ঘোষণা আসে এক দফার। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ছাড়া ছাত্রজনতা ঘরে ফিরবে না বলে ঘোষণা দেয় তারা। দুই দিনের (৪ ও ৫ আগস্ট) আল্টিমেটাম দিয়ে ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ ঘোষণা করা হয়। ওই দিন গণভবনমুখী পদযাত্রাও ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু ৪ আগস্ট সারাদেশে অনেক বেশি প্রাণ ঝরলে এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা নিয়ে রাতেই ঘোষণা দেয়, ‘পরশু নয়, আগামীকালই (৫ আগস্ট) ‘লং মার্চ টু ঢাকা’। মাইকে ঘোষণা দিয়ে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানানো হয়। এর পর ৫ আগস্ট তীব্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় এক স্বৈরতন্ত্রের। আর শুভ সূচনা হয় নতুন বাংলাদেশের।