২০২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থান। বাংলার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। এক গ্রীষ্মের দুপুরে শুরু হওয়া স্ফুলিঙ্গ এক প্রলয়ংকরী দাবানলে পরিণত হয়েছিল। শুরুতে কিছু তরুণ-তরুণীর কোটা সংস্কারের শান্তিপূর্ণ দাবি ছিল সেটি। কিন্তু রাষ্ট্রের বর্বরতার শিকার হয়ে সেই আন্দোলন ক্রমশই এক গণবিস্ফোরণে রূপ নেয়। প্রতিটি বুলেট, প্রতিটি লাঠিচার্জ যেন আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে শুরু হয়ে শহরের রাস্তা, গ্রামের গলি সবখানে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবাদের আগুন। একসময় এই আন্দোলন আর কোটা সংস্কারে আটকে থাকেনি বরং এটি হয়ে উঠেছিল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আপামর জনগণের হৃদয়ের ক্ষোভ। সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণে ভেঙে যায় এক স্বৈরশাসকের সিংহাসন।
এই গণঅভ্যুত্থানে দেশের সকল ফ্যাসিস্ট বিরোধী সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যাক্তি পর্যায়ে সকলে অংশগ্রহণ করে। তেমনি ভাবে এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা।
কেমন ছিল জুলাই আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী দিনগুলো, বর্ণনা করেছেন তিতুমীর কলেজের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
১০ জুলাই, মহাখালীতে বাংলা ব্লকেট:
এ দিনটি সম্পর্কে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক আহ্বায়ক আলাউদ্দিন মিনহাজ বলেন, ৫ জুলাই থেকে আমরা তিতুমীর থেকে শিক্ষার্থীদের একত্রিত করার চেষ্টা করি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের খুব একটা সাড়া পাইনি, আমি তিতুমীরিয়ান গ্রুপে পোস্ট করার পর সাড়া পেতে থাকি। একপর্যায় আমাদের ৯টি ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ হয়ে যায়। ১০ তারিখ বাংলা ব্লকেডের শেষ সময়ের প্রস্তুতি ছিল ৯ জুলাই। রাত থেকে আমরা সব কিছু ঠিক করি, প্ল্যান সাজাই। রাত ১০টার পর থেকে অচেনা নাম্বার থেকে কল আসতে থাকে। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কল দিতে থাকে। রাতে আমাকে বনানী থানা থেকে কল দেয় আর বলে আপনার নামে অভিযোগ আছে। আপনি এখন কই আছেন? আপনি এখনি বনানী থানায় আসেন। এদিকে আমাদের মহাখালি ব্লকেডের শেষ সময়ের প্রস্তুতি চলছে। তিতুমীর কলেজের সকল ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের যুক্ত করার শেষ চেষ্টা। এক পর্যায় রাত ২ টার দিকে আমরা ধারনা করতে পারি আমাদের মহাখালি ব্লকেডে ৮০০-৯০০ শিক্ষার্থী হবে। সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি আপনারা আন্দোলনের বিষয়টা সহপাঠীদের সাথে শেয়ার করবেন তাদের নিয়ে আসবেন।
তার পরের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, রাত ২:৩০ এর পর অচেনা টিএনটি নাম্বার থেকে কল আসলো তিতুমীরে আগামীকাল ভিআইপি আসবে ১০টার পরে যাতে ব্লকেডে কাউকে না দেখি, না হয় সমস্যা হবে। পায়ের হাড্ডি টুকরো টুকরো করে দেওয়া হবে। ১০ জুলাই সকাল বেলা ক্যাম্পাসের আসেপাশের গলিগুলোতে ছাত্রলীগ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়। আমাদের মিছিল শুরু হওয়ার স্থান ছিল ক্যাম্পাস মেইন গেইট থেকে। আমরা আগেই জানতাম আমরা মেইন গেইট থেকে শুরু করতে পারবো না। তাই আমরা স্থান দিই মহাখালি এসকেএস টাওয়ারে, শিক্ষার্থীদের জমায়াতের স্থান দিই সাউথপয়েন্ট স্কুল মাঠে। এতে ছাত্রলীগ আমাদের কোন প্ল্যান বুঝতে না পেরে তারা ক্যাম্পাস গেইটে অবস্থান নেয়। তাদেরকে এদিকে রেখেই আমরা সাউথ পয়েন্ট স্কুল মাঠ থেকে ৫০০-৬০০ শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে বের হই। মিছিল যতো আমতলীর দিকে যায় ততো মিছিলে শিক্ষার্থী সংখ্যা দ্বিগুন হতে থাকে। বেলা ১২ টার পরে সংখ্যা প্রায় ৬০০০-৭০০০ হাজারে পৌছায়।
সেই সময় কত হুমকি এবং ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হয়েছে তা উঠে এসেছে সাবেক আহ্বায়ক আলাউদ্দিন মিনহাজের কথায়, ১০ জুলাই মহাখালী ব্লকেড করার পর পরবর্তী কর্মসূচী বাস্তবায়ন করার চিন্তা, এদিকে অর্থ সংকট। রাতে আমাকে অচেনা নাম্বার থেকে কল দিতে থাকে। হুমকি-ধুমকি, মেরে ফেলার হুমকি দিতে থাকে। তবে ১১ জুলাই থেকে আমাকে বিভিন্ন জায়গা থেকে কল দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে নিতে অর্থ দিতে চায়। বেশীর ভাগেই গোয়েন্দা সংস্থার। একজন জানায় সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজির আহমেদ আন্দোলনের জন্য টাকা দিতে চাচ্ছে। সে তিতুমীরেও দিতে চায়। আমাদেরকে আন্দোলনে টাকা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ঘায়েল করতে চেয়েছে কিন্তু আমরা কোন মতেই এসবে পা দেইনি।
আলাউদ্দিন মিনহাজ বলেন, বাংলা ব্লকেডের পর আন্দোলন কোন দিকে যাবে এই নিয়ে কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের সাথে আলোচনা হয়। সেখানে পরামর্শ দেন আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া। ১৩ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সংবাদ সম্মেলনের পরে টিএসসির মাঠে ৭ কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে এই পরামর্শ করা হয়। তিতুমীরের পক্ষে আমি, সুজন, আল নোমান নিরব, জিসান ও মাহফুজ উপস্থিত ছিলাম। প্রথমে আমরা তিতুমীর থেকে ৮-১০ জনের একটি সমন্বয়ক টিমের নাম ঘোষণা করি বাংলা ব্লকেডে। পরে আসিফ ভাই পরামর্শ দেন আমরা যাতে ৩ লেয়ারে নেতৃত্ব তৈরী করি। সেই হিসেবে আমরা তিতুমীরে ডিপার্টমেন্ট ভিত্তিক সমন্বয়ক করি। আমরা জানতে চাই আমাদের আন্দোলনের সময়কাল কতদিন হতে পারে। আন্দোলন যতদিন ফলপ্রসূ না হবে ততদিন চালিয়ে যাওয়ার কথা জানানো হয়। আমি প্রশ্ন করি, আন্দোলনে হাসিনার ফ্যাসিস প্রশাসন ও তার দলের সন্ত্রাসীরা হামলা ও গ্রেপ্তার করলে আমরা তখন কি করবো? আমাদের এমন কোন সহায়তা আছে? প্রশ্নের জবাবে আসিফ মাহমুদ ভাই জানান, কিছু আইনজীবী আমাদের ফ্রিতে আইনি সহায়তা করবে বলে জানিয়েছেন, তবে এটা যথেষ্ট হবে না। আমরা আরো ট্রাই করবো। তবে চিকিৎসার ব্যাপারে তিনি কোন আশা দেখাতে পারেননি। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা তিতুমীরে কাজ করতে থাকি।সময়ে সময়ে পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়, পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে আমরা নিজেদের বুদ্ধিতে পরিচালনার চেষ্টা করি আন্দোলন।
১৯ জুলাই, শহীদ হন তিতুমীর কলেজে শিক্ষার্থী মামুন মিয়া:
এ দিনটি সম্পর্কে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারি তিতুমীর কলেজ শাখার সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক হেলাল উদ্দিন নাঈম বলেন, ১৮ই জুলাই থেকে বেড়ে যায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলার মাত্রা। সেদিন-ও মহাখালীতে র্যাব হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালিয়েছিল। আমরা একটা টিনের চালার নিচে আশ্রয় নেই। কাঁচের মত কিছু এসে আমাদের চালার উপড় ঝড়ঝড় শব্দে পড়তে থাকে। হাতিরঝিল থেকে আরেকটি হেলিকপ্টার দিয়ে পানি এনে সেতু ভবনের দিকে আগুন নিভানোর চেষ্টা করছিলো। পরদিন আমাদের তিতুমীরের শিক্ষার্থী শহীদ মামুন মিয়াকে হারিয়ে বিমর্ষ অবস্থা ছিলো সবার।
তিনি বলেন, শুনতে পেলাম বনানী থানা থেকে অভিযান চালনো হবে তিতুমীরের যারা আন্দোলন করছে তাদের লিস্ট জমা হয়েছে থানায়। ভাবলাম এবার মনে হয় জেলে যেতে হবে। হয়তো মেরে ফেলবে। রাতে আমরা মিটিং করি মহাখালী অবরোধ করবো আবারও। সবার একটাই সিদ্ধান্ত ছিলো জেলে নিলে সেখানেই মরতে হবে, তাহলে রাস্তায় গিয়েই মরবো। হয় আমাদের দাবি মানতে হবে এছাড়া আন্দোলন স্থগিত করবো না। তখন কোটা সংস্কারের সাথে আরেকটি দাবি যোগ হয়। তা হলো আমাদের ভাইদের মৃত্যুর বিচার নিশ্চিত ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করতে হবে। এই দিন গুলোতে শেখ হাসিনার পতন নিয়ে শ্লোগান হতো মানুষ মুখে। তখন আবু সাঈদসহ সবার মৃত্যু দৃশ্য চোখে ভাসছিলো। চার দিক থেকে মৃত্যুর খবর আসছে। আমাদের অনেককে গ্রেফতার করেছে। এসব শুনে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত সবাই। তবুও সকাল থেকে শুরু হয় মহাখালী অবরোধ। আমাদের তিতুমীরের সাথে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেয়। তখনো ট্রেন চলছিলো রেল গেইটে। আমরা ট্রেন অবরোধের সিদ্ধান্ত নেই। ঐ সময় বনানী ও তেজগাঁও থেকে পুলিশের সাঁজোয়া যান এসে গুলি ছুড়ছিলো। ছাত্রলীগ আগে থেকেই হামলা শুরু করে। টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় চোখ মুখ বন্ধ হয়ে আসছে। সিদ্ধান্ত নিলাম যেকোন মূল্যে ট্রেন বন্ধ করতে হবে। গুলির তীব্রতা বাড়লে মানুষ দৌড়াতে থাকে অনেকে দূরে আশ্রয় নেয়। সাহস করে আমরা তিন/চারজন হাত উচু করে রেল গেইটে দাঁড়িয়ে যাই। ট্রেন আসছে দেখেও আমরা সরে যাইনি। হঠাৎ দেখলাম ট্রেনটি বনানীর ঐ দিকে দাঁড়িয়ে যায়। এর মাঝে এক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমাদের দাঁড়ানো দেখে মানুষ সাহস খুঁজে পায়, হাজার হাজার মানুষ আবার রেল গেইটে চলে আসে।
হেলাল উদ্দিন নাঈম বলেন, ঐদিন সন্ধ্যার পর যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশ দল বেঁধে আবারও এসে খুব কাছাকাছি থেকে গুলি চালায় শুরু হয় নতুন সংঘর্ষ। আমার ডান হাতে ও পায়ের হাটুতে ছরড়া গুলির স্প্রিন্টার এসে লাগে। কেউ পিছু হঁটিনি। এর মাঝে দুইজন ভাই গুলিবিদ্ধ হয় মারাত্মক ভাবে। একজন একটু বয়স্ক আরেকজন ছাত্র। ওখানেই মৃত্যুবরণ করে। তাদের জুতা গুলো রেল গেইটে পড়ে ছিলো, রক্তে ভিজে গেছে রেল ক্রসিং। যেই ছবি আমার ফোনে আজও আছে। দেখলে বুক কেপে উঠে।
১৮ জুলাই, মহাখালী দখলমুক্ত হয় এবং তিতুমীর কলেজ থেকে বিতাড়িত হয় ছাত্রলীগ:
এ দিনটি সম্পর্কে তিতুমীর কলেজ ছাত্রশিবিরের এইচআরডি সম্পাদক ফারুক আহমেদ বলেন, সকাল থেকেই পুলিশ, ছাত্রলীগসহ আওয়ামী সন্ত্রাসীরা, তিতুমীর কলেজ, মহাখালী, আমতলী রেলগেট, মোড়ে অবস্থান নিয়েছে। কাউকে সন্দেহভাজন মনে হলেই তল্লাশি চালাচ্ছে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কয়েকজন একসাথে অবস্থান করা যাচ্ছে না। সকাল ১১ টার দিকে খবর পেলাম সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টরা আন্দোলনে নামতেছে। তারা ইউনিভার্সিটি থেকে নাবিঙ্কোর দিকে অগ্রসর হবে। পরিকল্পনা মহাখালী এরিয়া দখলমুক্ত করা। আলফে সানি ভাই (তিতুমীর কলেজের তৎকালীন শিবির সেক্রেটারি) দুপুর ১ টার দিকে নাবিস্কোতে অবস্থান করার নির্দেশনা দিলেন। তিতুমীর কলেজ শাখা শিবিরের শতাধিক নেতা-কর্মী সহ নাবিস্কোতে অবস্থান নিলাম। সেখানে ইতিমধ্যে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অসংখ্য শিক্ষার্থী অবস্থান নিয়েছে। পরিকল্পনা মত আমরা সবাই মহাখালী বাস টার্মিনাল হয়ে দুপুর ২টার দিকে মহাখালী রেল গেটের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলাম। কাছাকাছি যেতেই পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে শুরু করল। পুলিশের সাথে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন মারণাস্ত্র নিয়ে আমাদের উপর হামলা করতে এগিয়ে আসলে আমরা কিছুটা পিছু হটে পুণরায় সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছি। পুলিশ পুনরায় আমাদের উপর হামলা শুরু করে। সে সময় অনেক ভাইয়ের মাথা ফেটে যায়, অনেক ভাই আঘাত পেয়ে রক্তাক্ত হন।
তিনি বলেন, এমন সময় খেয়াল করলাম, (ICDDRB) হাসপাতালের উপর থেকে ব্যান্ডেজ নিচে ফেলা হচ্ছে। আশেপাশের গলিগুলোতে মেডিকেল সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই লড়াইয়ে আমাদের মনোবল বাড়াতে সাহায্য করেছে রাস্তার ধারে থাকা বাড়ির মানুষগুলো, তারা আমাদের খাবার পানি এবং বিস্কিটসহ অন্যান্য খাদ্য দ্রব্য দিয়ে সাহায্য করতেছিল। কিন্তু পুলিশের সামনে টিকে থাকা দুঃসাধ্য হয়ে যাচ্ছিল। আমাদের অসংখ্য ভাই আহত হচ্ছেন। তাদের সাথে আমরা পেরে উঠছিলাম না। পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা রেলগেট এবং আমতলী, কাঁচাবাজার দু দিক দিয়েই হামলা করছিল। তখন আমাদের হাতে ছিল শুধু ইটের টুকরো ও লাঠি। এ সময় কিছু সংখ্যক ভাই রেলগেটে দক্ষিণ দিক থেকে রেললাইন হয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এতে পুলিশ এবং আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দু দিক থেকে প্রতিহত হতে শুরু করল। তখন আমরা নারায়ে তাকবির–আল্লাহু আকবর স্লোগান দিয়ে সবাই সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলাম। দু দিক থেকে প্রতিরোধের মুখে পড়ে তারা পিছু হটতে শুরু করল। আমরা মহাখালী রেলগেট দখলে নিলাম। তখন তারা আমতলী ও মহাখালী কাঁচাবাজারের সামনে অবস্থান নিলো।
ফারুক আহমেদ বলেন, খবর পেলাম আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আমতলী মোরে অবস্থান করছে। আবারো নারায়ে তাকবিরা স্লোগান দিয়ে সকলে আমতলির দিকে অগ্রসর হতেই পুলিশ পিছু হটল, বনানীতে ঢুকে পড়ল। সাথে সাথে আওয়ামী- সন্ত্রাসীরাও তিতুমীর কলেজের দিকে পিছু হটল। বিকেল ৪.৩০ এর মধ্যে মহাখালী দখল মুক্ত হলো। ছাত্রদলের কিছু ভাইদের মিছিল–স্লোগান দিতে দেখলাম। সন্ত্রাসী ছাত্রলীগকে প্রতিহত করতে আমতলী থেকে তিতুমীর কলেজের দিকে অগ্রসর হল। কেউ কেউ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সামলে গড়িতে আগুন দিলে তা বড় হতে শুরু করলো। কলেজ হোস্টেল থেকে এই সময়ে ছাত্রলীগ হল থেকে পালাতে শুরু করলো। হল দখলমুক্ত হলো।
২০ জুলাই, স্নাইপার ও পুলিশি হামলার মুখে দমেনি আন্দোলনকারীরা:
এই দিনটি সম্পর্কে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ন আহ্বায়ক নীরব হাসান সুজন বলেন, ১৮-১৯ তারিখ গণহত্যা চলল। হেলিকপ্টার থেকে গুলি চলল। স্নাইপার দিয়ে আমাদের অনেককে শ্যুট করা হলো। আমাদের অনেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও অনেক সহযোদ্ধাদের সেই সৌভাগ্য হয়নি। এই ম্যাসারের মধ্যে আমরা ২০ তারিখ বনশ্রী ছিলাম। বিকেলে নামাজ শেষে একদল মুসল্লী বের হলে তাদের উপর স্নাইপার শ্যুট করা হলে দুইজন সেখানেই মৃত্যুবরণ করে। এতে সাধারণ মানুষ ক্ষেপে যায় এবং রণ প্রস্ততি গ্রহন করে। আমরাও আমাদের গ্রুপটাকে প্রস্তত হতে বলি এবং মানুষজন জড়ো করতে থাকি। সন্ধ্যায় শুরু হওয়া যুদ্ধ রণক্ষেত্রে পরিনত হয়। একদিকে রামপুরা থানার পুলিশ ও লীগের সন্ত্রাসীরা অন্যদিকে আমরা। কন্টিনিউ ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। আমার সাথে তৎকালীন তিতুমীর কলেজের ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি আফতাব মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আমরা যখনই মিছিল নিয়ে এগিয়ে যেতাম তখনই পুলিশ আমাদের উপর গুলি চালাত এতে অনেকেই মারাত্মক রকম হয় এবং বেশ কয়েকজন শহীদ হয়। ঐদিন রাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ১৪, ১৫ বছরের কিশোররা। তারা হাতে লাঠি নিয়ে মিছিলের আগে আগে চলে যেত এবং সবচেয়ে বেশি তারাই হতাহত হয়। আকাশে ড্রোন দিয়ে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে পুলিশ তথ্য নিচ্ছিল এবং আমরা যেসব কৌশলে আগাচ্ছিলাম সবগুলো কৌশল দ্বারা ভেস্তে দিচ্ছিল। আমরা লাঠি ইট পাটকেল নিয়েই সারারাত তাদের সাথে যুদ্ধ করি।
জুলাই আন্দোলনের সর্বশেষ দিনগুলি যেমন ছিল:
এ সম্পর্কে তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মিরাজ আল ওয়াসি বলেন, সারা বাংলাদেশে যখন আন্দোলন স্থবির হয়ে পড়েছিল তখনো আমরা ২২, ২৩ তারিখে আন্দোলন গড়ে তুলেছি মহাখালী রসূলবাগ রেললাইনে! রাত হলেই আমরা রেললাইনে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ প্রকাশ করতাম! আগুন জ্বালানোর পর পরই সেনাবাহিনী প্রচন্ড রকমের ফাঁকাগুলি ছুড়ে আমাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিত। এভাবেই আমাদের আন্দোলন স্থগিত হয়ে যায় ২৮, ২৯, ৩০ তারিখ পর্যন্ত। স্থগিত হওয়ার কারণটা হলো নেট এবং সার্ভার বন্ধ করে দেওয়া, আমরা কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। আমরা সামান্যতম টেলিগ্রাম ব্যবহার করতে পারতাম যা সবার ছিল না। বাকি ফোন নেটওয়ার্ক যেহেতু টেকিং হয় সেহেতু আমরা এইসব ফোনের সিম ব্যবহার করতে পারতাম না। আমরা আমাদের স্মার্টফোনগুলো নিয়ে যেতে পারতাম না আমরা বাটন ফোন ব্যবহার করতাম! কারণ ওই সময় যাকে সন্দেহ হয় তাকেই চেক হয়! ফোন চেক করতো আগে।
তিন তারিখ রাতে আমরা প্লান করলাম কোথায় কি করা যায়। ৪ আগস্ট আমরা ১১ টার দিকে মহাখালী রেলগেটে জড়ো হওয়া শুরু করলাম। তেমন কেউ ছিলনা, শুরু হয়ে গেল চারদিকে যোগাযোগ কিছু সমন্বয়ককে ফোন দিলাম কিন্তু পেলাম না। আমরা লোকজন ছিলাম ৩০-৪০ জন। আমি হতাশ হয়ে গেলাম যে ৩০-৪০ জন দিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা যাবে না। অপেক্ষা করতে শুরু করলাম ইতিমধ্যে খবর পেলাম মহাখালী বাস স্ট্যান্ড এবং মহাখালী আমতলী এবং তেজগাঁও থেকে সশস্ত্র ক্যাডার উপস্থিত হয়েছেন। সকলেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। মনোবল শক্ত রেখে লোকজন জড়ো করা শুরু করলাম বনানী থানা ছাত্রদলের সম্পাদকসহ আরও ৩০-৪০ জন একত্রিত হলাম। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দল যুবদলের সাথে যোগাযোগ করলাম আমরা এক দেড়শত লোক জড় হলাম। এবার আমরা প্লান মোতাবেক সেনাবাহিনীর দিকে আগানো শুরু করলাম, সেনাবাহিনীর সাথে বাকবিতণ্ডা করে আমরা ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজপথে নামলাম। ইতিমধ্যে আমাদেরকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারা। আমরা আইসিডিডিআরবির সামনে শক্ত অবস্থান নিলাম। মোহর মোহ স্লোগানের প্রকম্পিত করলাম ‘এই মুহূর্তে দরকার সেনাবাহিনীর সরকার’। তিন দিক থেকে আক্রমণের ফলে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের এক্সিট গেট ছিল শুধু আইসিডিডিআরবি পাশের একটা গলি। ঐদিন আমাদের অনেক সহযোদ্ধারা আহত হয়েছে।
আমরা বিকাল বেলা প্লান করলাম ৫ আগস্ট কি হতে যাচ্ছে! ইতিমধ্যে আমাদের কাছে নিউজ এসেছে ৫ আগস্ট প্রতিরোধ গড়ে তোলার। আমরা রাতের প্ল্যান মত ৫ আগস্ট সকাল সোয়া ১০টায় ১৪৪ দ্বারা ভেঙে মহাখালী রেল গেটে অবস্থান নিলাম। পরোক্ষণে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সাথে আমরা জাহাঙ্গীরগেটের দিকে রওনা দিলাম। বিএফ শাহীন কলেজের সামনে থেকে আমাদের আমাদের ফিরিয়ে দেওয়া হলো। ফলে আমরা সামনে এগোতে পারলাম না, আবার রাওয়া গেটে অবস্থান নিলাম। সেখানে স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত করলাম, এলাকায় জড়ো হলো আরো লোকজন। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা আমাদের বারবার চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। আমরা অবস্থান করে থাকলাম। পুলিশ গুলির প্রস্তুতি নিলে সেনা কর্মকর্তারা তাদেরকে বারণ করে।
এমন সময় একজন সেনা কর্মকর্তা এসে আমাদেরকে বললেন, আপনাদের উদ্দেশ্যে সেনাপ্রধান ভাষণ দিবেন। তখন আমরা নিশ্চিন্ত হলাম যে শেখ হাসিনা চলে যাবেন। আমরা উত্তরার মিছিল আসার অপেক্ষায় ছিলাম। তো একটার দিকে উত্তরার মিছিল মহাখালী প্রবেশ করলে আমরা তাদের সাথে মিলিত হই এবং শাহবাগ এর উদ্দেশ্যে রওনা হই। পিজি হসপিটাল এর সামনে যেতেই আমরা খবর পাই শেখ হাসিনা পালিয়েছে। এই খবর শুনে আনন্দ–উল্লাসে ফেটে উঠলো সকলে।
জুলাই আন্দোলনের বিজয় সহজ ছিল না। বর্ণানাকৃত দিনগুলো থেকে এটি স্পষ্ট বোঝা যায়। এটি অর্জিত হয়েছে অসংখ্য আত্মত্যাগ, অম্লান সাহস এবং অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। সেই যুদ্ধে রক্তের বিনিময়ে লেখা হয়েছে স্বাধীনতার নতুন অধ্যায়। যেখানে কিশোর থেকে বৃদ্ধ, ছাত্র থেকে সাধারণ মানুষ সবাই তাদের প্রাণের বিনিময়ে লড়াই করেছে। তাদের অদম্য প্রত্যয় আর সাহসই আজ আমাদের সামনে এনে দিয়েছে মুক্তির আলো, যা কোনো সময় ভোলা যাবে না। এই ত্যাগের স্মৃতিই আমাদের শক্তি ও প্রেরণা।