চট্টগ্রাম ব্যুরো: আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), বে-টার্মিনাল ও লালদিয়া পরিচালনায় ‘বিদেশি অপারেটর’ নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এর নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন।
রোববার (১০ আগস্ট) বিকেলে চট্টগ্রাম বন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এ কথা জানান। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসময় উপস্থিত ছিলেন।
মতবিনিময়ের আগে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বন্দরের চার নম্বর জেটি গেইটে এজেন্ট ডেস্ক এবং এরপর সিপিএআর গেইটে ভেহিক্যাল ও কনটেইনার ডিজিটাল ডাটা এক্সচেঞ্জ সিস্টেমের উদ্বোধন করেন।
এ বিষয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বন্দরের মধ্যে অনেকগুলো সংস্কার হচ্ছে। একটু আগে আমরা একটা সফটওয়্যার সিস্টেম উদ্বোধন করলাম, এটা একটা ফ্যান্টাস্টিক ইনিশিয়েটিভ, সবকিছু অটোমেটিক হয়ে যাবে। এর দুইটা সুবিধা আছে, এগুলো হচ্ছে- যে কাজটা করতে দুইদিন, সাতদিন, দশদিন সময় লাগতো, কাজটা করার জন্য সশরীরে গিয়ে কাগজ জমা দিতে হতো, সেটার বদলে এখন ঘরে বসে বাটন ক্লিক করেই কাজটা করে ফেলা যাবে। সময় সিগনিফিকেন্টলি কমে আসছে। একইসঙ্গে আমরা সবসময় যে অভিযোগটা সবার কাছ থেকে পাই, দুর্নীতির যে অভিযোগ এবং অনেকসময় হ্যারাসমেন্ট যেটা হয়, সেটাও সিগনিফিকেন্টলি কমে আসবে। এতে করাপশন ইনডেক্সেও আমাদের একটা সিগনিফিকেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট আসবে।’

বুধবার চট্টহ্রাম বন্দরে বিডা এর নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন – ছবি : সারাবাংলা
মতবিনিময়কালে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের মধ্যেই বন্দর নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হবে- জানিয়ে বিডা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, ‘বন্দরে যে প্রকল্পগুলো আছে, সেগুলো আমরা দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করবো। আমাদের অ্যাম্বিশন হচ্ছে, ডিসেম্বরের মধ্যে আমাদের বড় পোর্ট যেগুলো আছে, সেগুলোর মাইলস্টোন কিছু প্রোগ্রেস করে দিয়ে যেতে চাই। কিছু এগ্রিমেন্ট সাইন করে দিয়ে যেতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল টেন্ডারিংয়ের প্রসেস চলছে। আমাদের ইচ্ছা আছে, এ বছরের শেষ নাগাদ সবগুলো পোর্টের ক্ষেত্রেই, এনসিটি, বে-টার্মিনাল, লালদিয়া- তিনটার ক্ষেত্রেই এটলিস্ট প্রথম অপারেটরটাকে (সর্বোচ্চ দরদাতা) অ্যাপয়েন্ট করে দিয়ে যাওয়া। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই আমরা তিনটাকে প্রথম অপারেটরের কাছে হস্তান্তর করবো।’
বিডা চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা বন্দরকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, যেখানে চাকা ঘোরানো শুরু হয়েছে, সেখানে আর চাকা থামানো সম্ভব হবে না। ইলেকশনের পিরিয়ড আসছে। পলিটিক্যাল গর্ভনমেন্ট আসবে। তাদের সেটেল হতে তো সময় লাগবে। ওই সময়টাতে যাতে কোনো কাজ থেমে না থাকে, এ কাজগুলো যাতে এগিয়ে থাকে, সেটা আমরা করে দিয়ে যাব।’
এনসিটি চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথম নির্মিত ও সবচেয়ে বড় টার্মিনাল, যেটি ২০০৯ সাল থেকে দেশীয় বেসরকারি অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক পরিচালনা করে আসছিল। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার সাইফ পাওয়ারটেকের মেয়াদ শেষের পর এনসিটি পরিচালনার ভার দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয়ার প্রাক-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় তারা সে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে যেতে পারেনি। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসে সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে, যার বিরোধিতায় সরব হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রমিক সংগঠন।
এ অবস্থায় সাইফ পাওয়ারটেকের মেয়াদ শেষের পর গত ৬ জুলাই থেকে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় রাষ্ট্রায়ত্ত সামরিক জাহাজ মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেডকে।
ড্রাইডক দায়িত্ব নেওয়ার পর এনসিটি-তে আগের চেয়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিং বেড়েছে জানিয়ে আশিক মাহমুদ বলেন, ‘চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেড টেকওভার করার পর প্রথম একমাসে প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ কনটেইনার হ্যান্ডলিং ভলিউম বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা ড্রাইডক এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের জন্য একটা বিরাট অর্জন। অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, একজন অপারেটরের কাছ থেকে আরেকজন অপারেটরের কাছে গেলে দেশের কী হবে, হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে, সাতদিনের জন্য থেমে গেলে… ২০১১ সালে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল, সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা পারবো কী না- এ আশঙ্কা ছিল। কিন্তু ড্রাইডক, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং নৌবাহিনী মিলে খুব সুন্দরভাবে বিষয়টি হ্যান্ডলিং করেছে।’
‘একইসাথে আরও একটা পরিসংখ্যন বের হয়েছে যে, জাহাজের টার্ন অ্যারাউন্ড টাইমও শতকরা ১৩ শতাংশ কমে এসেছে। ৩০ শতাংশ ভলিউম বেড়েছে, সময় কমে এসেছে প্রায় ১৩ শতাংশ। গত অর্থবছরে আমাদের টোটাল ভলিউম ছিল ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন টিইইউস। ৩০ শতাংশ ভলিউম বৃদ্ধির বিষয়টি কন্টিনিউ করতে পারলে আমরা সেটা ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন টিইইউসে নিতে পারবো।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় বলেছি যে, বন্দরটা গ্লোবাল র্যাংকিংয়ে একেবারে টপ লিস্টে থাকতে হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এবং এজন্য বেস্ট অপারেটরদের নিয়ে আসতে হবে। আমাদের লং টাইম টার্গেট হচ্ছে, আমরা দেখতে চাই যে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের পোর্টের ক্যাপাসিটি চার-পাঁচগুণ বেড়ে যাবে। সবসময় যে অভিযোগটা আমরা বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং দেশি ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে শুনি যে, বাংলাদেশ থেকে একটা পণ্য ইউরোপের বন্দরে নিতে যে সময়টা লাগে, ভিয়েতনাম থেকে নাকি তার চেয়ে তিন-চারগুণ কম সময় লাগে। ২০৩০ সালে আমরা এটা শুনতে চাই যে, ভিয়েতনাম থেকে বাংলাদেশে কম সময় লাগে। ভিয়েতনামের সঙ্গে ম্যাচ করা নয়, তাদের চেয়ে আমাদের বেটার হতে হবে। সেজন্য আমাদের অনেক স্টেপস পার হয়ে যেতে হবে এবং সেজন্য আমরা রাইট ট্র্যাকে আগাচ্ছি।’
চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথম নিয়োগ পাওয়া বিদেশি অপারেটর রেড-সী গেটওয়ে টার্মিনালের (আরএসজিটি) অভিজ্ঞতা সুখকর নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আরএসজিটি আমাদের দেশে প্রথম ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট পোর্ট অপারেটর হিসেবে এসেছে। আরএসজিটি নিয়ে যে অভিজ্ঞতাটা হয়েছে বাংলাদেশের, এটা একেবারেই সুখকর না। উনারা এসেছেন, উনারা আরও কয়েকটা দেশে অপারেট করেছেন। ডিপি ওয়াল্র্ড বা এপিএম’র ৬০-৭০টা দেশে অপারেট করার অভিজ্ঞতা আছে, আরএসজিটি’র হয়তো এতটা দেশে অপারেট করার অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু বেশ কয়েকটা দেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে।’
‘বাংলাদেশে উনাদের খুব খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে, অনেক ধরনের জটিলতার মধ্যে উনারা পড়েছেন। সংকটটা হয়েছে মূলত, বাংলাদেশ সরকার কখনো ইন্টারন্যাশনাল অপারেটরদের ডিল করেনি। অনেক স্টেপে গিয়ে আটকে যেতে হয়েছে। এ কারণে আরএসজিটি যে ভলিউম গ্রোথ আশা করেছিল, সেটা হয়নি।’
দেশের জন্য যেটা ভালো হয় সেটা সরকার করবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল যে, ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন টিইইউস ভলিউম গ্রোথ তো ভালো, যেটা দেশের প্রতিষ্ঠান করছে, তাহলে বিদেশি অপারেটর কেন আনতে হবে ? অথচ পরিসংখ্যন বলছে, আমাদের গ্রোথ ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন টিইইউস পর্যন্ত হওয়া সম্ভব। ড্রাইডক যেভাবে করছে, তাতে তো মনে হচ্ছে ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। সুতরাং দেশের জন্য যেটা ভালো হয় সেটাই আমরা করবো।’
‘যদি ড্রাইডকের মাধ্যমে করলে আমাদের মনে হয় যে, বেস্ট অ্যাচিভমেন্ট সম্ভব, তাহলে সেটা করবো। আর যদি গ্লোবাল অপারেটর এলে আরও টেকনোলজিস এনে আরও বেশি ভলিউম অ্যাচিভমেন্ট সম্ভব, তাহলে আমরা সেই রাস্তায় যাবার চেষ্টা করবো।’