চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়ার বাসিন্দা এক চিকিৎসক রক্তাক্ত অবস্থায় ফেসবুকে লাইভে এসে তাকে বাঁচানোর আকুতি জানান। তিনি অভিযোগ করেন, বিএনপির সন্ত্রাসীদের চাঁদা না দেওয়ায় তাকে মারধর করা হয়েছে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এ ভিডিও নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়।
পুলিশ জানায়, ফেসবুকে লাইভের পাশাপাশি ওই চিকিৎসক জরুরি সেবা নম্বরে (৯৯৯) কল দিয়ে তাকে জিম্মি করে রাখার অভিযোগ করেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পারে, ভবন নির্মাণ নিয়ে প্রতিবেশির সঙ্গে ঝগড়ার একপর্যায়ে মারামারিতে তিনি আহত হন। কিন্তু ফেসবুকের লাইভে বিএনপির নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ করলে এলাকার লোকজনের ক্ষোভের মুখে পড়ে নিজেই একটি ভবনে ‘আত্মগোপন’ করেন। পুলিশের উপস্থিতি দেখে আবার নিজেই বের হয়ে আসেন।
কিন্তু ততক্ষণে ফেসবুকে বিএনপির সন্ত্রাসীদের চাঁদা না দেওয়ায় চিকিৎসককে মারধরের বিষয়টি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) বিকেলে নগরীর বাকলিয়া থানার কে বি আমান আলী রোডে পুরাতন চারতলা এলাকায়।
জানা গেছে, ফেসবুক লাইভে এসে নির্যাতনের অভিযোগ করা চিকিৎসক ইকবাল হোসেন (৩৮) চট্টগ্রাম নগরীর ইবনে সিনা হাসপাতালে কর্মরত আছেন। আহত হওয়ার পর তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
পুলিশ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, বাকলিয়ার পুরাতন চারতলা এলাকায় এয়ার মোহাম্মদ স্কুল লেইনে চিকিৎসক ইকবাল হোসেন একটি সাততলা ভবন নির্মাণের জন্য সিডিএর কাছ থেকে নকশা অনুমোদন করেছিলেন। এ অনুযায়ী তিনি ২০২২ সালে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেন। ২০২৪ সালের মার্চে তার প্রতিবেশি লাগোয়া ভবনের মালিক সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা হাজী ফরিদুল আলম ও তার স্ত্রী স্কুলশিক্ষিকা আমেনা বেগম সিডিএর কাছে ইকবালের বিরুদ্ধে নকশাবর্হিভূতভাবে ভবন নির্মাণের অভিযোগ করেন।
স্থানীয় মহল্লা কমিটির কাছেও তারা একই অভিযোগ করেছিলেন৷ এ নিয়ে এলাকাবাসী ‘বৃহত্তর রাহাত্তারপুল সমাজকল্যাণ পরিষদের’ ব্যানারে ইকবালের নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণের কাজ বন্ধ করার দাবিতে গতবছর মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। এর প্রেক্ষিতে গত বছরের ১০ নভেম্বর সিডিএর ইমারত কমিটি-১ এর সদস্য সচিব ও অথরাইজড অফিসার মোহাম্মদ হাসান বাকলিয়া থানাকে ইকবালের ভবন নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার পদক্ষেপ নেয়ার জন্য চিঠি দিয়েছিলেন।
এরপর সিডিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সরেজমিনে পরিদর্শন করে ইকবালের বিরুদ্ধে নকাশা বহির্ভূতভাবে সাততলা আবাসিক ভবনের স্থলে আটতলা নির্মাণের সত্যতা পান। এছাড়া ভবনের আশপাশের জায়গা ছাড় নিয়েও নকশা লঙ্ঘনের সত্যতা পাওয়া যায়।
এর প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ২১ মে সিডিএর ইমারত কমিটি ইকবালকে নোটিশ দিয়ে নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা এবং অননুমোদিত অংশ ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়। তবে সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে ইকবাল নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন বলে সিডিএতে ফের অভিযোগ করেন ফরিদুল ও আমেনা।
সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) বিকেলে সিডিএ’র ইমারত কমিটি-১ এর প্রকৌশলী কাজী কাদের নেওয়াজের নেতৃত্বে একটি টিম ভবনটি সরেজমিনে পরিদর্শনের জন্য যান। তার সামনেই উভয়পক্ষে ঝগড়া এবং একপর্যায়ে মারামারি শুরু হয়। এরপর সন্ধ্যায় ইকবাল ফেসবুকের লাইভে আসেন।
জানতে চাইলে সিডিএ’র প্রকৌশলী কাজী কাদের নেওয়াজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইকবাল হোসেনের নির্মাণাধীন ভবন নিয়ে একবছর ধরে প্রতিবেশির সঙ্গে বিরোধ চলে আসছে। উনি বেশকিছু ক্ষেত্রে আমাদের অনুমোদিত নকশা লঙ্ঘন করেছেন। আমরা আভিযোগ পেয়ে নোটিশ দিয়েছিলাম। পরে কাজ বন্ধ রেখে ভবনের অবৈধ অংশ ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিই৷ গতকাল (মঙ্গলবার) আমরা বিষয়টি সরেজমিনে দেখার জন্য গিয়েছিলাম।’
‘উভয়পক্ষকে ডেকেছিলাম। ইকবাল এবং অভিযোগকারী আমেনা বেগম ছিলেন। উভয়ে উভয়ের বিরুদ্ধে নকশা বহির্ভূত ভবন নির্মাণের অভিযোগ করেন। আমরা উভয়পক্ষকে অবৈধ অংশ চিহ্নিত করে দিয়ে সেগুলো ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিই।’
কাদের নেওয়াজ বলেন, ‘আমরা ফিরে আসবো, এমন সময় দেখি, দুই প্রতিবেশির মধ্যে কথা কাটাকাটি চলছে। এরপর দেখি হাতাহাতি হচ্ছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখানে শত, শত লোক জড়ো হয়ে যায়। তখন আমি দ্রুত সেখান থেকে ফিরে আসি। রাতে একটা ভিডিও দেখি ফেসবুকে, যেখানে ইকবাল বিভিন্ন অভিযোগ করেছেন।’
পুলিশ সূত্র জানায়, এ ঘটনার পরপরই ইকবাল পরিবারের লোকজন নিয়ে ওই এলাকায় তার ভবনের কেয়ারটেকার মো. মনজুরের বাসায় আশ্রয় নেন। সেখান থেকে তিনি প্রথমে বাকলিয়া থানার ওসিকে ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে সিডিএ কর্মকর্তার সামনে তাকে মারধরের অভিযোগ করেন এবং সহযোগিতা চান। এরপর ট্রিপল নাইনে কল দিয়ে তাকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে বলে পুলিশের সহযোগিতা চান। তখন বাকলিয়া থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়।
পুলিশ ঘটনাস্থলে থাকার মধ্যেই চিকিৎসক ইকবাল ফেসবুকে লাইভে আসেন। ৩৬ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে চিকিৎসককে বলতে শোনা যায়, ‘আমি ডাক্তার ইকবাল। বাকলিয়ায় পুরাতন চারতলায় আছি। আমাকে…বিএনপির হারুন; ওদেরকে সন্ত্রাসীদেরকে টাকা দিই নাই বলে আমাকে মারছে, আমাকে মারার জন্য খুঁজতেছে।
‘আমি লুকাই আছি একটা ঘরের মধ্যে। ৯৯৯-এ ফোন দিয়েছি। ২০-৩০ মিনিট হয়ে গেছে ওরা আসতেছে না। আমার ভাগনে-ভাগনিকে নিয়ে গেছে। আমাকে বাঁচান ভাই।’
পুলিশ সূত্র জানায়, লাইভে এসে বিএনপিকে জড়িয়ে চাঁদা দাবির অভিযোগ জানাজানির পর সেখানে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দলটির নেতাকর্মীরাসহ এলাকার শত, শত মানুষ তার ভবনের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।
জানতে চাইলে বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইখতিয়ার উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনা যা ঘটেছে সেটার প্রাথমিক তদন্তে আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের চাঁদা দাবি সংক্রান্ত কিছু পাইনি। নিয়মবহির্ভূত ভবন নির্মাণ নিয়ে সিডিএ অফিসারের উপস্থিতিতে বৈঠকে দু’পক্ষে হাতাহাতি হয়েছে। এতে চিকিৎসক ইকবাল আহত হন। কিন্তু তিনি ফেসবুকে পুরো ঘটনা উল্লেখ না করে একটি বড় রাজনৈতিক দলের নাম জড়িয়ে অভিযোগ করেন। এতে উত্তেজনা তৈরি হয়। পরে পুলিশের উপস্থিতিতে তিনি বের হয়ে আসেন।’
সিডিএর প্রকৌশলী কাজী কাদের নেওয়াজ সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, সিডিএর দেওয়া নোটিশের জবাবে চিকিৎসক ইকবাল তার কাছ থেকে চাঁদা দাবি ও লোহা, ইট, সিমেন্ট কিনতে বাধ্য করার অভিযোগ করেছিলেন।
তবে চিকিৎসক ইকবাল পুলিশের কাছে এ ধরনের অভিযোগ কখনো করেননি বলে ওসি জানান।
এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য চিকিৎসক ইকবাল হোসেনকে কয়েকবার ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।