ঢাকা: ‘প্রথমে পুলিশের গালাগাল। ঠিক একটু পর দৌড় দিতে বলেই পায়ে গুলি চালানো হয়। পেছনে ফিরে তাকালে চালান আরেকটা গুলি। তবু ক্ষান্ত হননি। গুলিতে ঝাঁঝরা করে ফেলা হয় গোটা দেহ। রক্তাক্ত শরীরে বাঁচার আকুতি জানালেও বুক কাঁপল না ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের। উলটো দাঁড়িয়ে মৃত্যু উপভোগ করেন তারা। এমনকি বুট জুতায় মাড়িয়ে বিকৃত করে দেওয়া হয় চেহারা।’
এভাবেই জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ভাই নিহত হওয়ার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিলেন শহিদ ইমাম হাসান তাইমের ভাই রবিউল আউয়াল। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সোমবার (১৮ আগস্ট) সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য ছিল। এদিন ১১ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন তিনি। তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল।
রবিউল বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমি সিলেটে অংশ নেই। আর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় অংশ নেন আমার ছোট ভাই তাইম। ১৬ থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত সারাদিন আন্দোলনে ছিল। তবে আন্দোলনে যেন যেতে না পারে সেজন্য তার ব্যাগ নিয়ে কাছাকাছি বসে থাকতেন আমার মা। ১৯ জুলাই রাতে কারফিউ জারি করে সরকার। ২০ জুলাই দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল ছিল। ওই সুযোগে মাকে চা খাওয়ার কথা বলে বাইরে গিয়ে আন্দোলনে যায় আমার ছোট ভাই।’
আন্দোলনে যাওয়ার পর তাইমকে দুবার কল করেন রবিউল। কিন্তু রিসিভ করেননি। দুপুর সাড়ে ১২টায় কল দিলে ছোট ভাইয়ের নম্বরটি বন্ধ পান তিনি। ১২টা ৫০ মিনিটে কল করেন মায়ের মুঠোফোনে। ঠিক তখনই রবিউলকে তাইমের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর জানানো হয়। বাড়িওয়ালার মাধ্যমে এমন সংবাদ পেয়েছেন বলেও ছেলেকে জানান মা।
জবানবন্দিতে সাক্ষী বলেন, ”তাইমের গুলিবিদ্ধের খবর পেতেই ঘটনাস্থল অর্থাৎ কাজলা ফুটওভার ব্রিজের পাশে যান আমার মা। যেতেই সেখানে তাইমের জুতা আর রক্ত দেখতে পান তিনি। তবে উপস্থিত লোকজন আমার মাকে জানান যে, ‘আপনার ছেলেকে ভ্যানে করে যাত্রাবাড়ী থানার দিকে পুলিশ নিয়ে গেছে’। এ ছাড়া খবরটি খালা শাহিদাকে জানাই আমি। পরে তিনি কান্না করতে করতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে খোঁজাখুঁজির পর তাইমকে না পেয়ে একজন সাংবাদিককে ছবি দেখান আমার খালা। এ সময় তায়িমকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে বলে জানান ওই সাংবাদিক।’
পরদিন ঢামেক থেকে মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় নিয়ে যান তাইমের বাবা। আর সিলেট থেকে বাড়িতে যান রবিউল। গ্রামেই ২১ জুলাই রাত ১০টায় শহিদ তাইমকে দাফন করা হয়। তাইমের শরীরে ২০০ ছররা গুলি ছিল বলে বাবার কাছ থেকে জানতে পারেন এই সাক্ষী। তার বাবাও পুলিশে চাকরি করেন। বর্তমানে একজন জ্যেষ্ঠ এসআই হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
তাইমের বন্ধুদের বরাতে রবিউল বলেন, ‘২০ জুলাই পুলিশ টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি ছুড়তে থাকলে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। ওই সময় দুই বন্ধুসহ কাজলায় লিটনের চায়ের দোকানে আশ্রয় নেন তাইম। তবে তাদের দেখে ফেলে পুলিশ। একপর্যায়ে তিনজনকে টেনে বের করে বেধড়ক পেটান। একইসঙ্গে গালি দিয়ে দৌড় দিতে বলেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। তাদের কথামতো প্রথমে দৌড় দেন তাইম। ঠিক তখনই তার পায়ে প্রথমে গুলি করেন যাত্রাবাড়ী থানার তৎকালীন এসআই সাজ্জাদুজ্জামান।’
প্রথম গুলি খাওয়ার পর পেছনে তাকান এই আন্দোলনকারী। তখন আরেকজনের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে তার শরীরের নিম্নাংশে দ্বিতীয় গুলি করেন এডিসি শামীম। খুব কাছ থেকে করায় তাইমের সামনের পাশে ঢুকে পেছন দিক দিয়ে গুলিটি বেরিয়ে যায়। এরপর তাকে অনবরত গুলি করতে থাকেন যাত্রাবাড়ী থানার তৎকালীন ওসি (তদন্ত) জাকির।
এ বর্ণনা দিয়ে সাক্ষী বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাইমকে বাঁচাতে পেছন দিয়ে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তার বন্ধু রাহাত। তখন তাকেও গুলি চালিয়ে তাইমকে ফেলে রেখে যেতে বাধ্য করে পুলিশ। রাহাত চলে যাওয়ার পর আধা ঘণ্টা পর্যন্ত পড়েছিল আমার ভাই। রক্তাক্ত শরীরে কাঁতরাচ্ছিল আর আকুতি করছিল বাঁচান বাঁচান বলে। সাংবাদিকসহ উপস্থিত অনেকেই তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ সদস্যরা তাকে নিতে দেননি। বরং তারা তার মৃত্যু উপভোগ করছিলেন। অথচ সেখান থেকে ২০ গজের মধ্যে রাস্তার দু-পাশে দুটি হাসপাতাল ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আধা ঘণ্টা পর ভ্যানে করে আমার ভাইকে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে নেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। সেখানে ভ্যান থেকে মাটিতে নামিয়ে বুট জুতা দিয়ে তাকে মাড়িয়ে চেহারা বিকৃত করে ফেলেন তারা। এর মধ্যে ছিলেন এডিসি শামীম, এডিসি মাসুদুর রহমান মনির ও এসি নাহিদ। পরে কেউ তাইমকে ভ্যানযোগে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
সেদিনের ঘটনাস্থলে পুলিশ কর্মকর্তাদের উপস্থিতি নিয়ে রবিউল বলেন, ‘২০ জুলাই ঘটনাস্থলে পুলিশের যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, যুগ্ম কমিশনার প্রলয়, ডিসি ইকবাল, এডিসি মাসুদুর রহমান মনির, এসি নাহিদ, এসি তানজিল, ওসি আবুল হাসান, ওসি (অপারেশন) ওয়াহিদুল হক মামুনসহ ১০-১৫ জন পুলিশ সদস্য ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতেই আমার ভাই তাইমসহ যাত্রাবাড়ীতে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের নির্দেশে আন্দোলনকারী প্রায় দুই হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। আমি তাদের ফাঁসি চাই।’
এদিন রবিউল ছাড়াও শেখ হাসিনার মামলায় আরও দুজন সাক্ষ্য দেন। এর মধ্যে একজন শহিদ আস-সাবুরের বাবা মো. এনাব নাজেজ জাকি ও রাজশাহীর প্রত্যক্ষদর্শী জসিম উদ্দিন। এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১২ জন সাক্ষী নিজেদের জবানবন্দি দিয়েছেন। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ২০ আগস্ট (বুধবার) দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।