Friday 22 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক
ইউক্রেন সংকট সমাধানে রাশিয়ার নতুন শান্তি প্রস্তাব

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২৩ আগস্ট ২০২৫ ০০:২৫

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ছবি: সংগৃহীত

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন সংকটের সমাধানে একটি নতুন শান্তি প্রস্তাব দিয়েছেন। পুতিনের প্রস্তাবের মূল শর্ত হলো ইউক্রেনকে পূর্ব দোনবাস অঞ্চল সম্পূর্ণরূপে ছেড়ে দিতে হবে, ন্যাটোতে যোগদানের লক্ষ্য ত্যাগ করতে হবে এবং পশ্চিমা সেনাদের উপস্থিতি থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে হবে।

ক্রেমলিনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, পুতিন এই শান্তি চুক্তির বিনিময়ে ইউক্রেনের কিছু অংশ ফিরিয়ে দিতেও রাজি আছেন। এই প্রস্তাব এমন এক সময়ে এলো, যখন উভয় দেশই যুদ্ধের অবসান চাইছে। তবে ইউক্রেন এই প্রস্তাবকে ইতিমধ্যেই তাদের দেশের টিকে থাকার লড়াইয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে জানিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার (২২ আগস্ট) রয়টার্সের এক বিশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।

আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের চার বছরের মধ্যে প্রথম শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। রুদ্ধদ্বার এই তিন ঘণ্টার বৈঠকের প্রায় পুরোটাই তারা ইউক্রেন সংকট নিরসনে একটি সম্ভাব্য আপস-আলোচনা নিয়ে কথা বলেছেন। বৈঠকের পর ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে পুতিন আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘এই বৈঠক ইউক্রেনে শান্তির পথ খুলে দেবে।’ তবে তারা কেউই আলোচনার বিস্তারিত কিছু জানাননি।

রয়টার্স তাদের প্রতিবেদনে পুতিনের নতুন প্রস্তাবের বিস্তারিত রূপরেখা প্রকাশ করেছে।

ক্রেমলিনের সূত্রগুলো জানিয়েছে, পুতিন তার আঞ্চলিক দাবি থেকে কিছুটা সরে এসেছেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ইউক্রেনকে মস্কোর দখল করা চারটি প্রদেশ— পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক (যা দোনবাস অঞ্চল) এবং দক্ষিণের খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া ছেড়ে দিতে হবে। তবে কিয়েভ এই শর্তকে আত্মসমর্পণের সমতুল্য বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল।

নতুন প্রস্তাবে পুতিন দোনবাসের যে অংশগুলো এখনো ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে আছে, সেগুলো পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে অনড় রয়েছেন। তবে সূত্রগুলো জানিয়েছে, এর বিনিময়ে মস্কো জাপোরিঝঝিয়া এবং খেরসনে বর্তমান যুদ্ধরেখা ধরে যুদ্ধবিরতি করবে। মার্কিন হিসাব এবং উন্মুক্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, রাশিয়া বর্তমানে দোনবাসের প্রায় ৮৮ শতাংশ এবং জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসনের প্রায় ৭৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে।

এ ছাড়া, একটি সম্ভাব্য চুক্তির অংশ হিসেবে রাশিয়া ইউক্রেনের খারকিভ, সুমি এবং দিনিপ্রোপেত্রভস্ক অঞ্চলের কিছু অংশও ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছুক বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।

পুতিন তার আগের দাবিগুলোতেও অটল রয়েছেন। এর মধ্যে আছে ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করা এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের পক্ষ থেকে আর পূর্বদিকে সম্প্রসারিত না হওয়ার একটি আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক প্রতিশ্রুতি। পাশাপাশি, ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর সীমাবদ্ধতা এবং কোনো পশ্চিমা সৈন্যকে ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে মোতায়েন না করার বিষয়ে একটি চুক্তি করার দাবিও তিনি ধরে রেখেছেন।

তবে উভয় পক্ষ এখনও অনেক দূরে আছে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলের পর এবং পূর্ব ইউক্রেনে রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে ইউক্রেনীয় সেনাদের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পর পুতিন হাজার হাজার রুশ সেনা নিয়ে ইউক্রেনে পুরোদমে অভিযান শুরু করেছিলেন।

ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই প্রস্তাব নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেননি। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বারবার একটি চুক্তির অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড থেকে সেনা প্রত্যাহারের ধারণাকে বাতিল করেছেন। তিনি বলেন, ‘শিল্পসমৃদ্ধ দোনবাস অঞ্চল হলো একটি দুর্গ যা রাশিয়ার অগ্রযাত্রা রুখে রেখেছে। বৃহস্পতিবার কিয়েভ থেকে প্রকাশিত এক মন্তব্যে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘যদি আমরা কেবল পূর্ব থেকে সেনা প্রত্যাহারের কথা বলি, তাহলে আমরা তা করতে পারি না। এটি আমাদের দেশের টিকে থাকার বিষয়, যার সঙ্গে শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যূহ জড়িত।’

এদিকে, ন্যাটোতে যোগদান ইউক্রেনের সংবিধানের একটি কৌশলগত লক্ষ্য এবং কিয়েভ এটিকে তাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা হিসেবে দেখে। জেলেনস্কি বলেন, ‘ন্যাটোর সদস্যপদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রাশিয়ার নেই।’

র‌্যান্ড করপোরেশনের রাশিয়া ও ইউরেশিয়া নীতি বিভাগের প্রধান স্যামুয়েল চারাপ বলেন, ইউক্রেনের দোনবাস থেকে সেনা প্রত্যাহারের যেকোনো শর্ত কিয়েভের জন্য রাজনৈতিক ও কৌশলগত উভয় দিক থেকেই অগ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন, অন্য পক্ষের কাছে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য শর্তে ‘শান্তির’ জন্য উন্মুক্ততা দেখানো ট্রাম্পের জন্য এক ধরনের অভিনয় হতে পারে, যা আপস করার প্রকৃত ইচ্ছার লক্ষণ নয়।

মার্কিন অনুমান এবং উন্মুক্ত মানচিত্র অনুযায়ী, রাশিয়ান বাহিনী বর্তমানে ইউক্রেনের এক-পঞ্চমাংশ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও রাজ্যের প্রায় সমান।

ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ তিনটি সূত্র জানিয়েছে, আলাস্কার অ্যাংকোরেজ শহরে অনুষ্ঠিত এই শীর্ষ বৈঠকটি যুদ্ধের শুরু থেকে শান্তির সেরা সুযোগ এনে দিয়েছে। কারণ এখানে রাশিয়ার শর্তগুলো নিয়ে নির্দিষ্ট আলোচনা হয়েছে এবং পুতিন কিছুটা ছাড় দিতে ইচ্ছুক বলে জানিয়েছেন।

একটি সূত্র জানায়, পুতিন শান্তি এবং আপসের জন্য প্রস্তুত। এই বার্তাই ট্রাম্পকে দেওয়া হয়েছে।

সূত্রগুলো সতর্ক করে বলেছে, ইউক্রেন দোনবাসের অবশিষ্ট অংশ ছেড়ে দিতে প্রস্তুত হবে কিনা, তা মস্কোর কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। যদি ইউক্রেন রাজি না হয়, তাহলে যুদ্ধ চলবে। এ ছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার দখল করা ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডের কোনো স্বীকৃতি দেবে কিনা, তাও স্পষ্ট নয়।

চতুর্থ একটি সূত্র জানিয়েছে, অর্থনৈতিক বিষয়গুলো পুতিনের কাছে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ হলেও তিনি রাশিয়ার অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং ইউক্রেনের আরও গভীরে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টার মাত্রা সম্পর্কে অবগত।

ট্রাম্প বলেছেন, তিনি এই ‘রক্তপাত’ শেষ করতে চান এবং ‘শান্তিস্থাপনকারী প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে স্মরণীয় হতে চান। তিনি গত সোমবার বলেছেন, রুশ ও ইউক্রেনীয় নেতাদের মধ্যে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করা শুরু করেছেন, যার পরে মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ একটি ত্রিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠক হবে।

ওভাল অফিসে জেলেনস্কির পাশে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প বলেন, আমি বিশ্বাস করি ভ্লাদিমির পুতিন এটি শেষ করতে চান। আমি আত্মবিশ্বাসী যে আমরা এর সমাধান করতে পারব।

তবে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বৃহস্পতিবার বলেন, পুতিন জেলেনস্কির সঙ্গে দেখা করতে প্রস্তুত, কিন্তু সব বিষয় প্রথমে সমাধান করতে হবে এবং একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের জন্য জেলেনস্কির কতটা কর্তৃত্ব আছে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

পুতিন বারবার জেলেনস্কির বৈধতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কারণ তার মেয়াদ মে ২০২৪-এ শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু যুদ্ধের কারণে নতুন কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। কিয়েভ অবশ্য বলছে, জেলেনস্কি এখনো বৈধ প্রেসিডেন্ট।

এদিকে, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানির নেতারা বলেছেন, পুতিন যুদ্ধ শেষ করতে চান, এমন ধারণার প্রতি তারা সন্দিহান।

দুটি রুশ সূত্র জানায়, ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এই শীর্ষ বৈঠকের এবং সর্বশেষ শান্তি প্রচেষ্টার পথ প্রশস্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। উইটকফ ৬ আগস্ট ক্রেমলিনে পুতিনের সঙ্গে দেখা করেন। সেই বৈঠকে পুতিন স্পষ্ট করে উইটকফকে জানান যে তিনি আপস করতে প্রস্তুত এবং শান্তির জন্য কী কী শর্ত তিনি মেনে নিতে পারেন, তার রূপরেখা তুলে ধরেন।

একটি সূত্র জানায়, যদি রাশিয়া ও ইউক্রেন একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে পারে, তাহলে একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তির জন্য বিভিন্ন বিকল্প রয়েছে। এর মধ্যে একটি সম্ভাব্য ত্রিপক্ষীয় রাশিয়া-ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি হতে পারে যা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ দ্বারা স্বীকৃত।

অন্য একটি বিকল্প হলো ২০২২ সালের ব্যর্থ ইস্তাম্বুল চুক্তিতে ফিরে যাওয়া। সেখানে রাশিয়া এবং ইউক্রেন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য— যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র এর কাছ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিনিময়ে ইউক্রেনের স্থায়ী নিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা করেছিল।

একটি সূত্র জানায়, দুটি পথ আছে: হয় যুদ্ধ অথবা শান্তি, আর যদি শান্তি না হয়, তাহলে আরও যুদ্ধ।”

সারাবাংলা/এইচআই

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ডোনাল্ড ট্রাম্প ভ্লাদিমির পুতিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া শান্তি চুক্তি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর