ঢাকা: এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের সময়সীমা ৩ থেকে ৫ বছর পিছিয়ে দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশের ১৬টি ব্যবসায়ী সংগঠন। সংগঠনগুলোর মতে, উত্তরণের পর শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা হারানো, ওষুধ ও তৈরি পোশাক শিল্পের সংকট মোকাবিলা এবং বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠার প্রস্তুতির জন্য এ অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন।
রোববার (২৪ আগস্ট) রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত ‘এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন: চ্যালেঞ্জেস অ্যাহেড’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে একাত্মতা প্রকাশ করেছে- এফবিসিসিআই, ডিসিসিআই, এমসিসিআই, সিসিসিআই, এফআইসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, বিএপিআই, বিএসআইএ, বিএবি, বিআইএ, বিএএমএলসি-সহ আরও কয়েককটি সংগঠন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আইসিসি বাংলাদেশ সভাপতি মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এলডিসি উত্তরণকে স্বাগত জানায়। এই অর্জন জাতির জন্য গর্বের হলেও সঠিকভাবে মোকাবিলা না করলে তা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বয়ে আনতে পারে। আমরা জোর দিয়ে বলছি, এলডিসি উত্তরণে ৩ থেকে ৫ বছরের একটি বাড়তি সময় পাওয়া জরুরি।
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বিতর্কটি উত্তরণ করা হবে ‘কি না’- তা নিয়ে নয়, বরং ‘কীভাবে’ করা হবে- তা নিয়ে। উত্তরণ নিশ্চিত, কিন্তু সাফল্য নিশ্চিত নয়। এটি নির্ভর করবে আমরা কত দ্রুত ও সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নিতে পারি এর ওপর।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিভিন্ন দেশ প্রস্তুতির জন্য এলডিসি উত্তরণ বিলম্বিত করেছে। মালদ্বীপ ৮ বছর, ভানুয়াতু ২০ বছর এবং নেপাল ৫ বছর সময় নিয়েছে। মিয়ানমার ও তিমুর-লেস্তে যোগ্যতা অর্জন করলেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে তাদের উত্তরণ স্থগিত রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের তিনটি মানদণ্ড- মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচক- দুই দফা পর্যালোচনায় পূরণ করায় বাংলাদেশ ২০২৬ সালের নভেম্বরে এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে।
আইসিসি সভাপতি বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ দেশের জন্য একটি বড় অর্জন হলেও এর সঙ্গে বেশ কিছু ঝুঁকি ও দায়িত্ব জড়িয়ে আছে। ২০২৬ সালের নভেম্বরে উত্তরণের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের মতো প্রধান বাজারগুলোতে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল হতে পারে, এর ফলে রফতানি ৬ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) অধীনে প্রাপ্ত বিশেষ সুবিধা, যেমন রফতানিতে ভর্তুকি এবং মেধাস্বত্ব আইনের (ট্রিপস) ছাড়, বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া, সহজ শর্তের বদলে বাংলাদেশকে বাজারভিত্তিক হারে ঋণ নিতে হবে, যা ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়াবে।
তিনি জানান, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ওষুধ ও তৈরি পোশাক শিল্প। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বর্তমানে স্থানীয় চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে এবং ১৫০টিরও বেশি দেশে রফতানি করে। মেধাস্বত্ব চুক্তিতে ছাড় পাওয়ার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। কিন্তু উত্তরণের পর এই সুরক্ষা উঠে গেলে ক্যান্সার ও এইচআইভির মতো জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ক্যান্সার চিকিৎসার ওষুধ ‘ইমাটিনিব’-এর মাসিক খরচ ৩০ থেকে ৪০ ডলার থেকে বেড়ে ২ থেকে ৩ হাজার ডলারে পৌঁছাতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি আরও জানান, দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮১ শতাংশের বেশি জোগান দেওয়া তৈরি পোশাক খাতকেও (আরএমজি) কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং কঠোর কমপ্ল্যায়েন্স আইন এ খাতকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।
দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটগুলো তুলে ধরে আইসিসি সভাপতি বলেন, এই পরিস্থিতিতে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা আরও কঠিন হবে। খেলাপি ঋণ এবং দুর্বল সুশাসনের কারণে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ২০২৪ সালে নিট বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) ১৩ শতাংশ কমে ১.২৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যেখানে ভিয়েতনামের এফডিআই ছিল ৩৮.২৩ বিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে রয়েছে জ্বালানি সংকট, লজিস্টিকস দুর্বলতা এবং ডলারের বিপরীতে টাকার ৪৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন, যা আমদানি খরচ ও মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে। জুলাই ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে ১০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ অর্থনীতিকে আরও নাজুক করেছে।