ঢাকা: ‘চব্বিশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান। ছাত্র-জনতার এ আন্দোলনে গিয়ে অসংখ্য মানুষ হারিয়েছেন প্রাণ। অঙ্গহানি হয়েছে আরও অনেকের। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুলিতে এক চোখ চিরতরে হারান ৪৯৩ জন। আর দুই চোখের আলো নিভে যাওয়ায় ১১ জনের জন্যই এখন পৃথিবী অন্ধকার। এমনকি দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন আরও অনেকে।’
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক জাকিয়া সুলতানা নীলার জবানবন্দিতে উঠে এসেছে এমন তথ্য। তিনি রেটিনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আজ সাক্ষ্য দেন ডা. নীলা। ২১ নম্বর সাক্ষী হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
সাক্ষীর ডায়াসে উঠে শুরুতেই নিজের পরিচয় দেন এই চিকিৎসক। এরপর জুলাই-আগস্টে তার প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নেওয়া চোখ হারানোদের বর্ণনা তুলে ধরেন তিনি। জবানবন্দিতে ডা. নীলা বলেন, ‘১৭ জুলাই থেকে আমাদের হাসপাতালে গুলিবিদ্ধরা আসতে থাকেন। ওই দিন গুলিবিদ্ধ পাঁচজন আসেন। আর ১৮ জুলাই দিনটি ছিল রক্তস্নাত দিন। সেদিন অপারেশন থিয়েটার বা ওটিতে ব্যস্ত ছিলাম। দুপুরের দিকে হাসপাতালে অনেক গুলিবিদ্ধ আহত এসেছেন বলে খবর আসে। তাদের চিকিৎসা দিতে হবে। আনুমানিক ১০০ রোগী ভর্তি হয়েছেন। আরও ১০০ জনকে জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘জরুরি বিভাগে যেতেই ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাই। অর্থাৎ গুলিবিদ্ধ হওয়া শতাধিক আহতকে দেখি। যাদের বয়স ১৪ থেকে ২৫ বছর। তাদের কেউ এক হাত দিয়ে এক চোখ, আবার কেউ দু-হাত দিয়ে দুই চোখ ধরে আছেন। যাদের সবার চেহারা রক্তস্নাত ছিল। ওই দিন রাত ৯টা পর্যন্ত ১০টি টেবিলে অস্ত্রোপচার চলে। পরদিনও একই চিত্র দেখতে পাই। সেদিনও সকাল ৮টা থেকে অস্ত্রোপচার শুরু হয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে।’
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অধিকাংশই মেটালিক পিলেট ও কেউ কেউ রিয়েল বুলেটে আহত ছিলেন। আহতদের ধরন ছিল কর্নিয়া ছিদ্র, চোখের সাদা অংশ ছিদ্র, চোখ ফেটে যাওয়া, রেটিনা আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া ও চোখে রক্তক্ষরণ।
এই সাক্ষী আরও বলেন, ‘৪, ৫ ও ৬ আগস্টেও আমরা অসংখ্য আহতকে চিকিৎসা দেই। তাদের অস্ত্রোপচার করা হয়। এর মধ্যে ৪৯৩ জন এক চোখ চিরতরে হারিয়েছেন। ১১ জন দুই চোখ হারিয়ে অন্ধত্ব জীবনযাপন করছেন। দুই চোখে দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন ২৮ জন। আর ৪৭ জন এক চোখে গুরুতর দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন। তবে এক চোখে সাধারণ দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন ৪৩ জন।’
নিরাপত্তার স্বার্থে কৌশল হিসেবে আহতরা নিজেদের আসল নাম গোপন করে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জবানবন্দিতে জানিয়েছেন ডা. নীলা। বলেন, অনেকেই ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। কেউ মোবাইল নম্বর আবার কেউ জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরও ভুল দিয়েছেন। এ সময় আহতদের ছবি-তথ্য সম্বলিত একটি পাওয়ার প্রেজেন্টেশন প্রদর্শন করা হয় ট্রাইব্যুনালে।
শেখ হাসিনার এ মামলায় ডা. জাকিয়া সুলতানা নীলা ছাড়াও আরও চারজন সাক্ষ্য দিয়েছেন আজ। জবানবন্দিতে সবাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাবেক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও ফাঁসি চেয়েছেন।