নীলফামারী: একসময় কৃষকের সেচ আর মাছচাষের প্রাণশক্তি ছিল নীলফামারীর ডিমলার নাউতারা নদী। কিন্তু উন্নয়নের নামে নেওয়া খনন প্রকল্প আজ স্থানীয়দের জীবনে সর্বনাশ ডেকে এনেছে। শতাধিক পরিবারের বসতভিটা, আবাদি জমি, সড়ক ও সরকারি অবকাঠামো নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কৃষি ও মাছচাষ নির্ভর জনপদ আজ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন—নদী যেন ভরসার বদলে এখন আতঙ্কের নাম।
পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের বিল থেকে উৎপত্তি হয়ে ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নাউতারা নদী গয়াবাড়ি ও নাউতারা ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বুড়ি তিস্তা নদীতে গিয়ে মিশেছে। একসময় নদী ঘিরেই গড়ে উঠেছিল কৃষক ও জেলেদের জীবনযাত্রা। কিন্তু ২০২১ সালে খননের পর বদলে যায় প্রাকৃতিক প্রবাহ, তৈরি হয় একাধিক চ্যানেল। এর পর থেকেই শুরু হয় ভয়াবহ ভাঙন।
স্থানীয়রা বলছেন, নদী যেন তাদের স্বপ্ন, জীবন ও বাড়ি এক রাতের মধ্যে গ্রাস করে নিয়েছে।

ধসে পড়েছে স্লুইসগেট, নদীর গতিপথ বদলে গিয়ে তৈরি হয় একাধিক চ্যানেল
জানা গেছে, ২০০৭ সালে কৃষি সেচ সুবিধা দিতে এলজিইডি নির্মাণ করে স্লুইসগেট। এর আশপাশে গড়ে ওঠে সেচ ও মাছচাষ নির্ভর জনপদ। কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থবছরে পানি উন্নয়ন বোর্ড ১২ কোটি টাকার খনন প্রকল্প হাতে নেয়, যার কাজ শেষ হয় ২০২১ সালে। খননের মাত্র এক মাসের মাথায় স্লুইসগেট ছয় ফুট নিচে দেবে অকেজো হয়ে যায়। এরপর ধসে পড়ে তিনটি সেতু, হেলে পড়ে আরও দুটি। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ছাতনাই, মিয়াপাড়া ও মধ্যপাড়া এলাকার চার কিলোমিটার বাঁধ কাম সড়ক। জমি ও বসতবাড়ি হারায় নদীর আশপাশের শতাধিক পরিবার।
পাউবো সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে নাউতারা নদীর ২৫ কিলোমিটার এলাকা খননের উদ্যোগ নেয়। খনন সম্পন্ন হয় ২০২১ সালে।
সরজমিনে দেখা গেছে, স্লুইস গেট ও সেতু ধসে পড়ে আছে নদীতে। ফলে সেচ ব্যবস্থা ও যাতায়াত পুরোপুরি ভেঙে গেছে। বাজারে কৃষিপণ্য পৌঁছানো বন্ধ, মাছচাষও বন্ধ। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় স্কুল, চিকিৎসা ও হাটবাজারেও চরম দুর্ভোগ।
স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, অপরিকল্পিত খননের কারণে এ ধস। পাঁচ বছর পার হয়েছে, তবুও ভাঙা স্লুইসগেট, সেতু ও সড়কের ধ্বংসস্তূপ অপসারণ করা হয়নি। আমাদের জীবন এখন অনিশ্চয়তার খাঁচায় বন্দি।

সড়ক ও সরকারি অবকাঠামো নদীগর্ভে বিলীন
পূর্ব ছাতনাই এলাকার বাসিন্দা আলিয়ার রহমান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘চোখের সামনে নদী সব গিলে ফেলল। রান্নাঘর, শোবার ঘর, বাচ্চাদের বইখাতা—এক রাতেই শেষ। প্রাণ নিয়ে বাঁচলাম, কিন্তু ভিটে তো আর ফেরত পাওয়া যাবে না। এখন শেষ সম্বল আবাদি দুই বিঘা জমিও নদী গিলছে।’
মিয়াপাড়ার কৃষক লাল মিয়ার কষ্ট আরও গভীর। তিনি বলেন, ‘তিন বিঘা জমি ছিল। ধান-ভুট্টা চাষ করতাম। নদী সব নিয়ে গেছে। এখন মজুরি খেটে বাঁচি। তার মতো অনেকে জমি হারিয়ে পুরোপুরি নিঃস্ব। বাজারে যেতে পারি না। আমাদের মাছচাষও বন্ধ। এই পাঁচ বছরে আমরা শুধু কষ্টই দেখেছি। কেউ খবর নেয়নি।’
শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে রহিমা বেগম নামের গৃহবধূ বলেন, ‘রাস্তা নাই, সেতু নাই বাজারে যাইতে পারি না, ডাক্তার দেখাইতে পারি না। সন্তান অসুস্থ হলে বুক ফেটে যায়, কিন্তু কিছু করার উপায় নাই।’
রাস্তা ভেঙে পড়ায় স্কুলগামী শিশুদের প্রতিদিন কাদা মাড়িয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। ছাতনাই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী খাদিজা আক্তার জানান, ‘কাদা মাড়িয়ে যেতে যেতে প্রায়ই স্কুলে দেরি হয়ে যায়। পড়াশোনায় মনও বসে না। অনেক সময় মনে হয়, আমাদের স্বপ্নও নদীর জলে তলিয়ে যাচ্ছে।’
নদী ঘিরে কৃষি ও মাছচাষে সফল হতে স্থানীয়রা গঠন করেছিল ‘ক্ষুদ্র পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি’। সদস্যরা চাঁদা দিয়ে সেচব্যবস্থা চালাতেন, মাছচাষ করতেন। কিন্তু খননের পর সবকিছু ভেঙে পড়ে।সমিতির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন বললেন—‘আমাদের স্বপ্নই নদীর গর্ভে হারিয়ে গেছে। পাঁচ বছরেও ভাঙা স্লুইসগেট, সেতু অপসারণ হয়নি। এভাবে ভাঙন আরও ভয়াবহ হচ্ছে। সরকার যদি পাশে না দাঁড়ায়, এলাকা জনশূন্য হয়ে যাবে।’
সমিতির সদস্য মোক্তার আলী বলেন, ‘উন্নয়নের নামে নেওয়া উদ্যোগ যদি মানুষের জীবন, জীবিকা ও স্বপ্নকে নষ্ট করে, তবে সেটি কি সত্যিই উন্নয়ন? ’
নদী নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও’ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সদস্য সোহেল হাসান বলেন, ‘নদী খননের আগে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন অত্যন্ত জরুরি। নাউতারায় সেই নিয়ম মানা হয়নি। ফলে, ভাঙন ঠেকাতে খনন প্রকল্পটি এখন পরিণত হয়েছে সর্বনাশের কারন।’
স্থানীয়দের দাবি, সরকার যেন দ্রুত কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করে। তারা প্রশ্ন করেন, এত বড় প্রকল্প নেওয়ার আগে কেন করা হলো না যথাযথ পরিকল্পনা ও পরিবেশগত মূল্যায়ন?
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, ‘খননের পর নদীতে ভেঙে পড়া অবকাঠামোর কারণে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ভাঙন বাড়ছে। অবকাঠামোগুলো এলজিইডি’র আওতায়। তাই অপসারণ করা হয়নি। দ্রুত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।’ তবে খননের আগে পরিবেশগত মূল্যায়ন হয়েছিল কি না, সে বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
এদিকে ডিমলা উপজেলা প্রকৌশলী শফিউল ইসলামে এবং জেলা প্রকৌশলী ফিরোজ হাসানও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।