ঢাকা: ‘মানুষ নির্মাণ করে প্রয়োজনে, সৃষ্টি করে আনন্দে, বুদ্ধির পরিচয় দেয় জ্ঞানে, যোগ্যতার পরিচয় দেয় কৃতিত্বে, নিজের পরিচয় দেয় সৃষ্টিতে’— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলাদেশের গ্রামীণ অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিক ছিলেন এই মর্মবাণীর প্রতিবিম্ব। আজ তার ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের সমগ্র জীবনই ছিল সৃষ্টির আধার। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন একাধারে প্রকৌশলী, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনাবিদ, প্রযুক্তিবিদ ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের স্বপ্নদ্রষ্টা। তারই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফসল আজকের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)।
কুষ্টিয়া অধিবাসী কৃষিচিন্তক প্রয়াত নূরুল ইসলাম সিদ্দিক এবং রত্নগর্ভা মা বেগম হামিদা সিদ্দিকের কোল আলো করে পৃথিবীতে এসেছিলেন ১৯৪৫ সালে। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক তার শৈশব ও শিক্ষা জীবনের প্রথম অধ্যায় কেটেছে লালন শাহ, রবীন্দ্রনাথ এবং মীর মশাররফ হোসেনের স্মৃতিধন্য কুষ্টিয়ায়। ১৯৬৬ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ১৯৬৭ সালে জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে জন্মশহর কুষ্টিয়াতেই কর্মজীবন শুরু তার। প্রকৌশল পেশার জ্ঞান কাজে লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল ভারতের ‘বেতাই’ ইয়্যুথ ক্যাম্প থেকে কুষ্টিয়া-পাবনা অঞ্চল হানাদার মুক্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রণাঙ্গনে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রকৌশলী হিসেবে তিনি মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা দিতে বিভিন্ন রাস্তা ও সেতুর নকশা প্রণয়ন করে যুদ্ধের অপারেশনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। আবার যুদ্ধ শেষে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ার কাজেও ছিলেন অগ্রগামী। বিদ্যুৎ ও পানিসহ বহু খাতেই বিপ্লব ঘটেছে তার হাত দিয়েই। রাবার ড্যাম দিয়ে কৃষির পানি ধরে লক্ষ্যে প্রলয়ঙ্কারী বন্যা ঠেকানোর প্রকৌশলী ধারণা ছিল তারই প্রকৌশল জ্ঞানের স্বাক্ষর। ‘জিআইএস’ ও ‘জিপিএস’ বিপ্লবের প্রথম প্রহরেই বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছিলেন ‘ডিজিটাল ম্যাপিং’।
সত্তরের দশকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আওতায় যে ইঞ্জিনিয়ারিং সেল গঠন করা হয়েছিল সেই পল্লীপূর্ত কর্মসূচিকে উন্নয়ন বাজেটের আওতায় ‘ওয়ার্কস প্রোগ্রাম উইং’-এ রূপান্তরের মাধ্যমে ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে ওয়ার্কস প্রোগ্রাম উইং রাজস্ব বাজেটের আওতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল ব্যুরো (এলজিইবি) রূপে পুনর্গঠন করেন। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালের আগস্ট মাসে এলজিইডিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) হিসেবে উন্নীত করা হয়।
যানজট কমিয়ে রাজধানীবাসীকে স্বস্তি দিতে আজকের যে মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেসওয়ে, তা ২০০৪ সালে কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের নকশা করা ঢাকা পরিবহণ সমন্বয় বোর্ডের (ডিটিসিবি) কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনা (এসটিপি)। বিদেশের মাটিতে বসেই দেশে পাতাল সড়কের প্রকৌশল নকশা নিয়ে অপর প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরীকে মেইল পাঠাতেন তিনি। কেবল গ্রাম নয়, হাতিরঝিল থেকে পাতাল রেল সব পরিকল্পনাতেই জুড়ে আছে তার নাম। তিনি ছিলেন ভিশনারি টেকনোক্র্যাট।
শুধু অবকাঠামো খাতেই নয়, তার চিন্তার ব্যাপ্তি ছড়িয়েছেন প্রযুক্তি খাতেও। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে প্রথম দু’টি আইবিএম মেইনফ্রেম কম্পিউটার পিসি এনে এলজিইডিতে ব্যবহার শুরু করেন তিনি। সেই কম্পিউটার দেশে অনুপ্রাণিত হয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদও রাষ্ট্রীয় কাজে কম্পিউটারের ব্যবহারে আগ্রহী হন। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক অবদান রেখেছেন ভূমি ব্যবস্থাপনাতেও। ১৯৮৮ সালে জমির মৌজার হার্ড কপি ম্যাপের ডিজিটাল ম্যাপিং শুরু করেন এই ‘বড় স্যার’। ১৯৯৪ সালে ইন্টারনেট, ই-মেইল এর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়েবসাইটও তৈরি করান কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। পিডিবি’র চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের সময় খুলনা থেকে ডিজিটাল বিলিং সিস্টেম চালু করেন। ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে পরিসংখ্যান ব্যুরোর সঙ্গে জনশুমারিতে প্রকৌশলী জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। ডিএলআরএস সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে যে ম্যাপিং করেছেন তাকে ভিত্তি করেই আজ কাজ করছে প্রতিটি সরকারের অধিদফতর।
এছাড়াও, আজ থেকে ২৭ বছর আগে ১৯৯৯ সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগের জন্য জিআইএস ব্যবহার কাস্টম ম্যাপিং সফটওয়্যার তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি। তার সুদক্ষ পরিচালনায় পিডিবি পেয়েছিল নতুন আলোর সন্ধান। তার যুগোপযোগী কর্মকাণ্ডে পূর্ত মন্ত্রণালয় জেগে উঠেছিল নতুন স্বপ্ন নিয়ে। সবশেষে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের কর্মকাণ্ড নিয়েও নতুনভাবে চিন্তার সূত্রপাত করেছিলেন। এভাবেই সরকারি কর্মকর্তাদের চিরাচরিত নিয়ম ভেঙে নিজে কাজ করে অন্যদের কাজ শেখানো এবং প্রশিক্ষণ ও উদ্ভাবনে আমৃত্যু সহকর্মীদের অনুপ্রাণিত করেছেন কামরুল ইসলাম সিদ্দিক।
কম সময়ের মধ্যেই নানা দূরদর্শী উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রশংসা কুড়িয়েছেন দেশে-বিদেশে এই প্রাজ্ঞপ্রাণ। স্থানীয় সরকার প্রকৌশলে বিশ্বব্যাংক থেকে ‘ম্যাজিক বয়’ স্বীকৃতিতে ভূষিত হন এই বিচক্ষণ প্রশাসক কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। দেশেও অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। প্রকৌশলে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৭ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে।