লালমনিরহাট: উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস মৌজায় দাঁড়িয়ে আছে ইসলামী ঐতিহ্যের এক বিস্ময়কর নিদর্শন। স্থানীয়ভাবে একসময় ‘হারানো মসজিদ’ নামে পরিচিত এই স্থাপনাটি আজ পরিচিত হয়েছে ‘৬৯ হিজরি হারানো (সাহাবা) মসজিদ কমপ্লেক্স’ নামে। প্রায় ১৪০০ বছরের পুরোনো এ স্থাপনা কেবল বাংলাদেশের নয়, সমগ্র এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন মসজিদ হিসেবেও গবেষকদের দৃষ্টি কেড়েছে।
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৩–৮৪ সালে জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়ে প্রথমে উন্মোচিত হয় ধ্বংসাবশেষ। ১৯৮৬ সালের ১০ মহররম স্থানীয় এক ব্যক্তি খোদাইকৃত একটি ইট আবিষ্কার করেন। ইটটিতে খোদাই করা ছিল শাহাদাতের বাণী— “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” এবং সঙ্গে লেখা হিজরি সন ৬৯। এই ইটই প্রমাণ দেয় মসজিদটির বয়স প্রায় ১৩৫০ বছর। বর্তমানে এটি মসজিদের ভেতরে সংরক্ষিত আছে।

খোদাইকৃত আবিষ্কৃত ইটে লেখা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” এবং সঙ্গে লেখা হিজরি সন ৬৯। ছবি: সারাবাংলা
মসজিদের ধ্বংসাবশেষে এখনও দৃশ্যমান মোটা খাঁজকাটা ইট, অলংকৃত মেহরাব, খিলান, দেয়াল ও চারটি স্তম্ভের অবশেষ। আরবীয় নকশার স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায় স্থাপত্যে। ইতিহাসবিদদের মতে, ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক পর্যায়ে সাহাবায়ে কেরাম এ অঞ্চলে এসে এ মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। ধারণা করা হয়, হজরত আবু ওয়াক্কাছ (রা.) চীনে যাওয়ার পথে এখানে অবস্থানকালে এর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তৎকালীন ব্রহ্মপুত্র–তিস্তা অববাহিকা ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথ, যা মসজিদটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়।
স্থানীয়দের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘আস-সাহাবা কমপ্লেক্স’। বর্তমানে ‘৬৯ হিজরি হারানো (সাহাবা) মসজিদ কমপ্লেক্স’-এ রয়েছে একটি কওমি মাদ্রাসা, যেখানে প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে নামাজ আদায় করতে আসেন।
স্থানীয় শিক্ষক রিয়াজুল ইসলাম রাজু জানান, ‘১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে মসজিদের খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এখানে আসছেন, কেউ নামাজ পড়তে, কেউবা ইতিহাস ছুঁয়ে দেখতে।’
ইতিহাস ও আধ্যাত্মিকতা অনুভবের প্রসঙ্গে এক দর্শনার্থী বলেন, ‘এই মসজিদ দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে দর্শনার্থীরা আসেন। তাই মসজিদের পরিবেশ এমনভাবে উপস্থাপন করা প্রয়োজন, যাতে প্রবেশ করলেই দর্শনার্থীরা ইতিহাস ও আধ্যাত্মিকতা অনুভব করতে পারেন।’
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মাওলানা আব্দুল বাতেন মনে করেন, সরকারি উদ্যোগে পরিবেশ উন্নয়ন হলে দর্শনার্থীরা ইতিহাস আরও গভীরভাবে অনুভব করতে পারবেন।
মোয়াজ্জিন সোলাইমান আলী জানান, ‘প্রতিষ্ঠান পরিচালনা আরও শক্তিশালী হলে এর যথাযথ মূল্যায়ন সম্ভব হবে।’
ইমাম তাওহীদুল ইসলাম বলেন, ‘সংরক্ষিত ইট ও স্থাপত্য উপাদান এ অঞ্চলের ইসলামী ঐতিহ্যের অমূল্য সাক্ষ্য।’
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ. এম. রকিব হায়দার জানান, ‘প্রাচীন ‘হারানো মসজিদ’ ইসলামী ঐতিহ্যের অমূল্য নিদর্শন। এর স্থাপত্য ও পরিবেশ উন্নয়নে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’