ইসরায়েল কাতারে হামলার এক সপ্তাহ পর কাতারের রাজধানী দোহায় একটি জরুরি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে আরব লীগের সদস্য দেশগুলোসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশের নেতারা অংশ নেন। সেখানে ন্যাটোর আদলে ‘জয়েন্ট আরব ফোর্সেস’ বা যৌথ আরব বাহিনী গঠনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
৯ সেপ্টেম্বর কাতারে ইসরায়েলি হামলার প্রেক্ষিতে দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল গাজায় প্রায় দুই বছর ধরে চলমান যুদ্ধ এবং মানবিক বিপর্যয় থামাতে ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা। সম্মেলনে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নিরাপত্তা এবং ইসরায়েলের আগ্রাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও আলোচনায় আসে।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বিবিসির প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়।
সোমবার শুরু হওয়া আরব-ইসলামিক সম্মেলনে মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি এই যৌথ আরব বাহিনী গঠনের প্রস্তাব তোলেন বলে জানা যাচ্ছে।
এই বাহিনী গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে ন্যাটো জোটের আদলে। অর্থাৎ ন্যাটো জোটভুক্ত প্রত্যেকটি দেশ যেমন জোটের কোনো একটি দেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লে ঐ দেশের নিরাপত্তায় সেনা সহায়তা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এই যৌথ আরব বাহিনীও সেভাবেই কাজ করবে বলে প্রস্তাব তোলা হয়েছে।
আরব দেশগুলোর ওপর হামলা হওয়া বা তাদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ার মত ঘটনার পাশাপাশি আরব বিশ্বের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ও সন্ত্রাসবাদী হামলা ঠেকানোর মত বিষয়গুলো নিয়ে এই বাহিনী কাজ করবে বলে প্রাথমিক প্রস্তাবনায় উঠে এসেছে।
সেনা সদস্যের দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তি মিশর চায় কায়রোতে এই বাহিনীর সদর দফতর স্থাপন করতে।
ন্যাটোর মত এই বাহিনীতেও বিমান, নৌ ও স্থল বাহিনী থাকবে বলে প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। সহযোগী দেশগুলোর সেনাবাহিনীর সক্ষমতা ও আকৃতির ওপর নির্ভর করবে কোন দেশ এই বাহিনীতে কতটুকু অবদান রাখবে।
বিশ্লেষকরা এই প্রয়াসকে ‘আরব ন্যাটো’ বলে উল্লেখ করছেন।
এর আগে ২০১৫ সালেও মিশর একই ধাঁচের যৌথ আরব বাহিনী গঠনের আহ্বান জানিয়েছিল। সেসময় ইয়েমেন, লিবিয়া, সিরিয়ার মত দেশগুলোতে বিভিন্ন ইসলামপন্থী সশস্ত্র গ্রুপের বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম রোধে ঐ বাহিনী গঠনের প্রস্তাব জানিয়েছিলেন মি. সিসি, যিনি সেসময়ও মিশরের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
তবে আরব লিগের বেশ কয়েকটি দেশ সেসময় ঐ বাহিনী গঠনে আগ্রহী না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সেই যৌথ বাহিনী গঠন সম্পন্ন হয়নি।
সম্মেলনে উপস্থিত দেশগুলো ইসরায়েলের ওপর আইনি, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ বাড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘ থেকে ইসরায়েলের সদস্যপদ স্থগিত করারও আহ্বান জানানো হয়েছে যৌথ বিবৃতিতে। পাশাপাশি গাজায় জরুরি ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিত করা, গাজার স্থাপনা পুনর্নির্মাণ ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ও উল্লেখ করা হয়েছে যৌথ বিবৃতিতে।
এই বিবৃতি ছাড়াও একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ নিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার উদ্দেশ্যে গঠিত জোট গঠিত গাল্ফ সিকিউরিটি কাউন্সিল, জিসিসি।
জিসিসি তাদের বিবৃতিতে কাতারে হামলার জন্য ইসরায়েলের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি উল্লেখ করেছে যে জিসিসির সহযোগী ‘যে কোনো দেশে হামলা, সবার ওপর হামলার শামিল।’
সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে কাতারের আমির মন্তব্য করেছেন যে ইসরায়েল গাজা থেকে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার উদ্দ্যেশ্যেই কাতারে হামাস নেতাদের বৈঠকে হামলা চালিয়েছে।
কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি তার উদ্বোধনী বক্তব্যে মন্তব্য বলেন, ‘ইসরায়েল যদি হামাস নেতাদের হত্যাই করতে চায়, তাহলে তাদের সঙ্গে আলোচনা করার কথা বলছে কেন?’
তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘আপনি (ইসরায়েল) যদি জিম্মিদের মুক্তিদের জন্য দর কষাকষিই করতে চান, তাহলে সেই বিষয়ে কাজ না করে আলোচনাকারীদের (হামাস নেতা) হত্যা করছেন কেন?’ এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা সম্ভব নয় বলেও তার বক্তব্যে মন্তব্য করেন কাতারের আমির।
সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি বলেন, ‘ইসরায়েলের কার্যক্রম পুরো মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তাকেই হুমকির মুখে ফেলছে। এই আগ্রাসনে পরিষ্কারভাবে দেখা যায় যে ইসরায়েল সব ধরনের রাজনৈতিক বা সামরিক যুক্তি বহির্ভূত কাজ করছে, এবং তারা সব সীমা অতিক্রম করেছে।’
দোহায় আরব লীগ ও ওআইসি’র দেশগুলোর এই জরুরি সম্মেলন নিয়ে অনেকে আশাবাদী হলেও বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন এই সম্মেলন থেকে ইতিবাচক কিছু অর্জন হবে না। কাতারে ইসরায়েলের হামলার পর কাতারের প্রধানমন্ত্রীর ওয়াশিংটন সফর নিয়েও চলছে সমালোচনা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে এই সম্মেলন থেকে ‘নিন্দা জ্ঞাপন’ ছাড়া আর কিছু অর্জন হবে না।
ইয়েমেনের রাজনীতিবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক শেখ হুসেন হাজেব সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে পোস্ট করে মন্তব্য করেছেন যে এই জোটের ‘উত্থানের আগেই মৃত্যু’ হবে।