Thursday 18 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিশ্বাস করতে না পেরে নিজেই ছেলের পোড়া লাশ দেখি— শহিদ সজলের বাবা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:২৫ | আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:৩৯

ছবি: সারাবাংলা

ঢাকা: পুলিশের পিকআপভ্যানে লাশের স্তূপ। আগুনে পোড়ানো এসব লাশ একে একে বের করে মোড়ানো হচ্ছিল পলিথিনে। তবু অশ্রু চোখেই অঙ্গার হয়ে যাওয়া দেহ দেখে চেনার চেষ্টা স্বজনদের। এরমধ্যেই ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি কার্ড পেয়েছিলেন এক বাবা। কিন্তু বিশ্বাস করতে না পেরে নিজেই দেখতে চেয়েছিলেন পুলিশের দেওয়া আগুনে পোড়া সন্তানের দেহ। লাশ খুলে দেখাতেই ভেঙে পড়েছিলেন কান্নায়। তার আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছিল সেদিনের বাতাস।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হৃদয়স্পর্শী এমনই বর্ণনা উঠে এসেছে শহিদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের বাবা খলিলুর রহমানের মুখে। গত বছরের ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় ছয়জনের লাশ পোড়ানোসহ সাতজনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামসহ ১৬ আসামির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ ছিল বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর)। এদিন দুই নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন খলিলুর। ট্রাইব্যুনাল–২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।

বিজ্ঞাপন

জবানবন্দিতে খলিলুর রহমান বলেন, সিটি ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করতো আমার ছেলে। পাশাপাশি একটি কোম্পানিতে পার্টটাইম চাকরি করতো। আমার স্ত্রী, ছেলে ও ছেলের স্ত্রী ভাড়া বাসায় আশুলিয়া থাকতো। আমাদের একটি নাতনি রয়েছে। তার বয়স দুই বছর। গত বছরের ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১১টায় স্ত্রী আমাকে ফোন দিয়ে জানায়, আমার ছেলে মিছিলে গেছে। আমার স্ত্রীও ডিউটিতে ছিল। বিকেল ৫টায় আমার ডিউটি শেষে আমি আমার ছেলের নম্বরে ফোন দেই। তখন ফোন বন্ধ পাই। আমি আমার স্ত্রীকে খোঁজ নিতে বলি। আমার স্ত্রী জানায় যে, তার কর্মস্থল হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ লোক আসতেছে। আমার স্ত্রী অনেক চেষ্টার পরও আমার ছেলের মোবাইলে সংযোগ পায়নি।

তিনি বলেন, আমার স্ত্রীর সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ডিউটি ছিল। আমি আমার স্ত্রীকে বলি যে, রাস্তার পরিস্থিতি ভালো না হওয়ায় যেতে পারছি না, তুমি খুঁজতে থাকো। ডিউটি শেষ করে শান্ত নামে একটি ছেলেকে নিয়ে খুঁজতে থাকে আমার স্ত্রী। শান্ত আমার ছেলের সজলের বন্ধু। ওই রাতে আমার ছেলে আর বাসায় আসেনি। পরদিন সকালে আমি ফজর নামাজ পড়ে মোটরসাইকেল নিয়ে পঙ্গু হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে, ঢাকা মেডিকেলসহ বিভিন্ন হাসপাতালে আমার ছেলের খোঁজখবর নেই। ছেলেকে না পেয়ে দুপুরের পর আশুলিয়ার দিকে রওনা হই। দুপুরে বাসায় এসে জোহরের নামাজ পড়ি। পরে আমার ছেলের বন্ধু শান্ত আমাকে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। বিকেল ৩টায় একজন ছেলে আমাকে ফোন দিয়ে আমাকে আওলিয়া থানা সংলগ্ন মসজিদের সামনে আসতে বলেন। আমি আমার স্ত্রীকে ফোন দিয়ে জানালে আমার স্ত্রী আমার ছেলের বউ, মেয়েকে নিয়ে বাইপাইলে আসে।

আমার স্ত্রী আমাকে বলে, মসজিদের সামনে একটি পুলিশের পিকআপভ্যানে লাশ পোড়া অবস্থায় রয়েছে। তাদের লাশ দেখতে দেয়নি। পরে আমিসহ সবাই মিলে একত্রে মসজিদের সামনে যাই। তখন আগুনে পোড়া লাশগুলো এক একে বের করে পলিথিনে মোড়ানো হচ্ছিল। লাশের সঙ্গে থাকা মালামাল চেক করছিল। আমার ছেলের সঙ্গে দুটি ইউনিভার্সিটি কার্ড ছিল। আমার ছেলের লাশের সঙ্গে দুটি কার্ডই পাওয়া যায়, যা দেখে শনাক্ত করা হয়। আমি বিশ্বাস করতে না পেরে নিজেই লাশ দেখতে চাই। তখন আমাকে লাশ খুলে দেখায়। আমরা সবাই মিলে লাশ দেখি। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন সাক্ষী।

এই সাক্ষী আরও বলেন, আমার ছেলের বুকের পাশ দিয়ে একটি কাটা দাগ ছিল। আমরা ওই দাগ ও কার্ড দেখে ছেলেকে শনাক্ত করি। উপস্থিত স্থানীয় সমন্বয়ক ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা জানাজা শেষে আমাদের লাশ বুঝিয়ে দেন। লাশ নিয়ে আমরা নারী ও শিশু হাসপাতালের জামগড়ার সরকারি মার্কেট মাঠে আসি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে লাশের কাগজপত্র রেডি করে দেয়। সেখানে একবার জানাজা হয়। জানাজা শেষে আমরা লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছাই। সেখানে আরেক দফা জানাজা শেষে আমার ছেলে শহিদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের দাফন হয়।

তিনি আরও বলেন, ২৫-২৬ দিন পর আমরা মোবাইলে ও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে কয়েকটি ভিডিও দেখি। ভিডিওতে আমাদের ছেলেকে কিভাবে মারে তা আমরা দেখতে পাই। যেখানে আমাদের ছেলেকে মারা হয় সেখানে পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিল। আমরা কিছু নাম জানতে পারি। ওসি সায়েদ, ওসি মাসুদ, ওসি নির্মল, ডিবি আরাফাত, কামরুল, আফজাল হোসেন, কাফি, শাহিদুল, সাইফুল এমপি, রনি ভূঁইয়ার নাম জানতে পারি।

সারাবাংলা/আরএম/ইআ

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ছেলের পোড়া লাশ জবানবন্দি জুলাই শহিদ জুলাই-আগস্ট গণআন্দোলন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর