চট্টগ্রাম ব্যুরো : কাল (রোববার) মহালায়। দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে বাঙালি হিন্দু জাতিগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় আয়োজন শারদীয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। হিন্দুদের আচার অনুযায়ী মহালয়া, বোধন আর সন্ধিপূজা- এই তিন পর্ব মিলে দুর্গোৎসব। মহালয়ায় মণ্ডপে-মণ্ডপে চণ্ডীপাঠ, মঙ্গলঘট স্থাপন, ঢাক-কাঁসা ও শঙ্খ বাজিয়ে দেবীকে আবাহনের মধ্য দিয়ে সূচনা হবে দুর্গোৎসবের।
শরতের আগমণের সঙ্গে সঙ্গে দুর্গাপূজোর আগমনী বার্তাও ধ্বনিত হয়, যা বোঝা যায় মৃৎশিল্পীদের প্রতিমা তৈরির আখড়াগুলোতে। খড়-মাটিতে গড়া প্রতিমার অবয়ব দাঁড়িয়ে যায় কাঠের ওপর। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মৃৎশিল্পীদের ব্যস্ততার পাল্লাও ভারি হতে থাকে। মহালয়া যখন সমাগত, তার আগ থেকেই শুরু হয় রঙ-তুলির আঁচড়ে প্রতিমার পূর্ণাঙ্গ অবয়ব ফুটিয়ে তোলার মহাযজ্ঞ।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এবারও এমন চিত্রের ব্যতিক্রম নেই। নগরীর দেওয়ানজীপুকুর পাড়ের রূপশ্রী শিল্পালয়, হাজারী লেনের মহামায়া স্টুডিও, সদরঘাটের লোকনাথ শিল্পালয়, নটরাজ শিল্পালয়, স্বর্গীয় দুলাল পাল প্রতিমালয়- সবখানেই শিল্পীর রঙ-তুলির বর্ণিল কারুকাজে মূর্ত হয়ে উঠছে প্রতিমার রূপ। দিন-রাত চলছে কাজ, দম ফেলার অবসরটুকু নেই শিল্পীদের।
কয়েকটি শিল্পালয় ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটিতে ১৫ থেকে ৪০টি পর্যন্ত প্রতিমা তৈরি করা হচ্ছে। শিল্পালয়ের চারপাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে দেবী দুর্গার প্রতিমা এবং লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ। মাটির কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন চলছে রঙের খেলা। এরপর সাজসজ্জা। তারপর মহাষষ্ঠীর দিনে মৃন্ময়ী মূর্তি যাবে মণ্ডপে-মণ্ডপে।
নগরীর চকবাজার মক্কী মসজিদ এলাকার মৃৎশিল্পী পরেশ পাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা অর্ডার অনুযায়ী প্রতিমা তৈরি করি। এর সঙ্গে এক্সট্রা কিছু রাখি। অনেকসময় রেডিমেইড বিক্রি হয়। হাতে আরও সপ্তাহখানেক সময় আছে। এর মধ্যেই প্রতিমার সাজসজ্জার কাজটা হয়ে যাবে।’
নগরীর এনায়েত বাজার গোয়ালপাড়া এলাকার মৃৎশিল্পী বিশ্বজিত পাল বলেন, ‘আমর আষাঢ়ের শুরু থেকে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করেছি। মাটি আর রঙের কাজ আমাদের শেষ হয়ে গেছে। এখন প্রতিমা সাজাচ্ছি। এরপর গহনা আর শাড়ি পরানো হবে। এবার আমরা ১৪টি মণ্ডপের জন্য প্রতিমা তৈরি করেছি।’
নগরীর বিভিন্ন শিল্পালয়ে তৈরি প্রতিমাগুলোর অধিকাংশই যাবে শহরের মধ্যে বিভিন্ন পূজামণ্ডপে। অবশ্য শহরের বিভিন্ন পূজামণ্ডপেও প্রতিমা তৈরি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট নিখিল কান্তি নাথ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার নগরীর ১৬ থানায় ২৯৫টি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা হবে। আমরা ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র, সিএমপি কমিশনার, জেলা প্রশাসকের সঙ্গে মিটিং করেছি। সেখানে সুন্দরভাবে দুর্গোৎসব ও প্রতিমা বিসর্জনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। পূজা উদযাপনের সব প্রস্তুতি আমাদের সম্পন্ন হয়েছে। আশা করছি, সুন্দরভাবে পূজা সম্পন্ন হবে।’
এদিকে চট্টগ্রাম জেলার ১৫ থানায় এবার ২২০২টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হবে। এর মধ্যে প্রতিমা পূজা ১৫৮৫টি এবং ঘটপূজা ৬১৭টি। প্রতিমা পূজামণ্ডপের মধ্যে ৯৫০টি স্থায়ী ও ৬৩৫টি অস্থায়ী।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নিরাপত্তা বিবেচনায় এবার ৩৫৬টি পূজামণ্ডপকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ, ৭১৬টিকে গুরুত্বপূর্ণ এবং ১১৩০টিকে সাধারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৪৪০টি পূজামণ্ডপে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হচ্ছে।
বিজয়া দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন হবে ১৭১৬টি। পরদিন হবে ২১টি। আর ৪৬৫টি মণ্ডপের প্রতিমা বিসর্জন হবে না।
জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে পূজামণ্ডপের নিরাপত্তায় ১৭ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
নির্দেশনাগুলো হল- পূজা কমিটির ভেটিংকৃত স্বেচ্ছাসেবকদের তালিকা সংশ্লিষ্ট থানার ওসির কাছে জমা দেওয়া, প্রতিটি পূজা মণ্ডপে ডিভিআরসহ সিসিটিভি বা আইপি ক্যামেরা স্থাাপন ও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা, নির্দিষ্ট স্থানে ভলান্টিয়ারদের সহযোগিতায় গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা, প্রতিটি থানায় এবং পুলিশ সুপার কার্যালয়ে ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা থাকবে, দ্রুত প্রতিক্রিয়ার জন্য থানাভিত্তিক বিশেষ টিম গঠন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে এমন দুষ্কৃতিকারীদের তালিকা পুলিশকে সরবরাহ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো থেকে সতর্ক থাকা এবং সংশ্লিষ্ট লিংক দ্রুত মুছে ফেলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে, পূজা উদযাপন পরিষদের কমিটি সংক্রান্ত বিরোধ দ্রুত মিমাংসা, পূজামণ্ডপের সামনে ও পেছনে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা এবং বিদ্যুৎ চলে গেলে জেনারেটর বা চার্জার লাইট ব্যবহার নিশ্চিত করা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সম্প্রীতি কমিটি গঠন করে সতর্কতা অবলম্বন, পূজা মণ্ডপের আশপাশে রাস্তা ও ফুটপাতের অবৈধ দোকান উচ্ছেদ এবং রাস্তায় গাড়ি পার্কিং বন্ধের ব্যবস্থা করা, পূজা উপলক্ষে কোনো মেলা বা অন্য অনুষ্ঠান আয়োজন নিরুৎসাহিত করা এবং নির্ধারিত সময়ে প্রতিমা বিসর্জন শেষ করা।
এছাড়া যে কোনো পরিস্থিতিতে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ০১৩২০-১০৮৩৯৮ নম্বরে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানানো হয়।
উল্লেখ্য, আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর ষষ্ঠী পূজোর মধ্য দিয়ে দুর্গোৎসব শুরু হবে। ২ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে সমাপ্তি হবে।