Saturday 20 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ডোমার থানার ওসির কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৫:৪৭ | আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৭:২৬

ডোমার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আরিফুল ইসলাম।

নীলফামারী: ডোমার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিএনপির অঙ্গ সংগঠন নিয়ে কটুক্তি, মামলার বিনিময়ে অর্থ বাণিজ্য, মাদক কারবারিদের কাছ থেকে কমিশন গ্রহণ, টাকা নিয়ে মামলা গ্রহণ এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওসির অপসারন ও শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও ঝাড়ু মিছিলসহ নানান কর্মসূচি পালন করেছেন স্থানীয়রা।

এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে একাধিক ভিডিও। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ডোমার থানার ওসি বিএনপির অঙ্গ সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলকে কটূক্তি ও হুমকির ভাষা ব্যবহার করছেন। ভিডিওটি নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ভিডিওতে থানায় ধুমপানরত অবস্থায় স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতার উদ্দেশে বলতে শুনা যায়, “আমি যেমন হিরো বানাইতে পারি তেমন জিরো বানাইতে পারি, নেতা কিন্তু বানায় পুলিশ। যদি ভবিষ্যতে কোনো প্ল্যান থাকে তাহলে কিন্তু একদম জিরোতে নামাই দেব। করে তো স্বচ্ছাসেবক দল আর ভাব নেয় ওসির ওপর দিয়ে, বাটাম খুলে দেব একদম। এই স্বচ্ছাসেবক দলটাই কিন্তু বেশি মাঠে গ্যাঞ্জাম করছে। আমি কিন্তু আপনাদের চাইতে বেশি পলিটিক্স জানি। আমি বুকে নিতে পারে কিন্তু ছুঁড়ে মারতে পারি।”

আরেক ভিডিতে দেখা যায়, নিজ নামে টিকটক খুলে সিগারেট খাওয়াসহ নানান বিষয়ে ভিডিও আপলোড করেন ওসি আরিফুল। তার নামের টিকটক আইডির শর্ট ভিডিতে অভিনয় করতে দেখা যায়, “জীবনে আপনি বিড়ি কয়টা খাইছেন? সেই ভিডিওতে ওসি ঠোট মিলিয়ে বলে, বিড়ি আমি একটাও খাইনি বাপু। গরীব মানুষ টাকা পয়সা নাই, তাই সিগারেট খাই।” এরপর এক হাতে সিগারেট প্যাকেট ভিডিওতে তুলে ধরেন।

সেবা প্রত্যাশী ওসির সঙ্গে ঘুষ লেনদেনসহ নানা বিষয়ে অভিযোগ তুলে ধরেন। এনায়েত কবির নামের এক ব্যক্তি পারিবারিক একটি সমস্যা নিয়ে থানায় গেলে তাকে দেখেই ওসি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ”আপনি থানায় কেন বের হন মিয়া, আপনি কেন থানায় আসছেন। এ সময় এনায়েত কবির কথা বলতে চাইলে তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অপমান করে জোড়পূর্বক থানা থেকে বের করে দেন।

এ বিষয়ে এনায়েত কবির জানান, ওসির এমন আচরণের কারণে আমি হতাশ ও অপমানিত হয়ে থানা থেকে বের হয়ে আসি। এরপর নীলফামারীর এসপি স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে অনলাইনে জিডি করার পরামর্শ দেন।

ডোমার থানার ওসি আরিফুল ইসলামের আচরণ আওয়ামী ফ্যাসিবাদীর মতো উল্লেখ করে ওসির শাস্তি দাবি করেন এনায়েত কবির।

আরেক ভুক্তভোগী ডোমার সদর ইউনিয়নের এক দম্পতি স্কুলে পড়ুয়া তাদের নাবালিকা মেয়েকে উদ্ধার ও আইনি সহায়তা চেয়ে থানায় অভিযোগ করেন। ডোমার থানার ওসি তাদের সঙ্গে কথা না শেষ করে গালাগালি করে থানা থেকে বের করে দেন। ওই দম্পতি জানান, তাদের মেয়ে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। সে প্রেমের সম্পর্কের জেরে একটি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে বলে বাবা-মা থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গিয়েছিলেন।

তারা দাবি করেছেন, ঘটনার সময় কৌশলে ওসির কথাগুলো ফোনে রেকর্ড করেন। ওই রেকর্ডিংয়ে ওসিকে বলতে শোনা যায়, “এই ব্যাপারটা আমি জানি, প্রেমের সম্পর্কের কোনো ভিত্তি নাই। আপনারা থানা থেকে বের হয়ে যান, আমার থানায় যেন আপনাদের না দেখি।” পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের সহায়তায় ওই দম্পতির অভিযোগ নেওয়া হয় বলে তারা জানান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডোমার উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা জানান, এবারের ঈদে ডোমার সদর, হরিনচড়া ও বোড়াগাড়ি—এই তিনটি ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যানদের কল দিয়ে টাকা দাবি করেন ডোমার থানার ওসি আরিফুল ইসলাম। তবে টাকার বিনিময়ে ওই তিন আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যানকে নিজ নিজ বাড়িতে থেকে তিন দিন ধরে ঈদ করার সুযোগ করে দেন তিনি। এতে প্রত্যেকে ৩০ হাজার টাকা করে মোট ৯০ হাজার টাকা ওসিকে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন ওই নেতা।

তার ভাষ্যমতে, ডোমারের ওসি আশ্বাস দিয়েছেন র‌্যাব, পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার বিষয়গুলো তিনি টাকার বিনিময়ে সামাল দেবেন। টাকার বিনিময়ে দীর্ঘদিন ধরে ডোমার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তোফায়েল আহম্মেদকে গ্রেফতার না করে এলাকায় প্রকাশ্যে চলাফেরার সুযোগ দিয়েছেন ওসি আরিফুল।

আমিনুর রহমান নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, “জমি নিয়ে পারিবারিক বিরোধের ঘটনায় ডোমার থানায় মামলা করতে যাই। প্রথমে ওসি মামলা রেকর্ড করতে নারাজ। পরে ওসিকে ১০ হাজার টাকা দিলে মামলা রেকর্ড হয়। এরপর আবার পুলিশের খরচের কথা বলে আমাদের কাছ থেকে আবারও টাকা নিয়েছে।”

প্রশাসনের গোয়েন্দা শাখার এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি আরিফুলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, একটা কাজে ডোমার থানায় গিয়েছিলাম আমাদের কাজের আগেই সরাসরি বস্তা ভর্তি টাকার আবদার করেন ওসি আরিফুল।

ডোমারের একাধীক সাংবাদিক অভিযোগ করেন পুলিশের পোশাকে ওসির চেয়ারে বসে প্রকাশ্যে ধুমপান ও মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে প্রায় সময় খারাপ আচরণ করেন।

এর আগে, ১৮ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) ওসি আরিফুল ইসলামের অপসারণ ও শাস্তির দাবি প্রসঙ্গে ডোমার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে নীলফামারী পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করছেন এলাকাবাসী। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ডোমার থানা কর্মরত ঘুষখোর অফিসার ইনচার্জ আরিফুল ইসলাম ডোমার থানায় যোগদানের পর থেকে নানামুখী অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছেন। তিনি বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে মাসহারা আদায় ও না দিলে হয়রানি হুমকি, মামলা নথিভুক্ত করতে ঘুষ নেওয়াসহ নানা অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছে। এতে একদিকে সেবা প্রার্থীরা যেমন হয়রানীর স্বীকার হচ্ছেন, অপরদিকে ভুক্তভোগীর পকেট কেটে ওসির আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ।

এ ঘটনার ভুক্তভোগী স্থানীয় সাংবাদিক আসাদুজ্জামান হিল্লোল জানান, ডোমার কাজীপাড়া এলাকার কুখ্যাত মাদকসম্রাজ্ঞী রূপার পক্ষ নিয়ে ওসি সাংবাদিক তাকে হুমকি দেন। এর আগে গত ৫ বছর আগে রুপার বেপরোয়া মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে এলাকাবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করলে সে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রশাসনের সহায়তায় ২৭ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ে করে। এর কয়েক মাস হয়রানির পর মিমাংসার মাধ্যমে মামলা তুলে নেয়।

তিনি জানান, দিন দিন মাদকসম্রাজ্ঞী রুপা মাদক ব্যবসায় বেপরোয়া হয়ে উঠলে প্রশাসন তাকে বহুবার গ্রেফতার করে। কিন্তু নিমিষের জেল থেকে বের হয়ে আবারও মাদক ব্যবসায় নামে রুপা। তার এমন অপকর্মের কারণে এলাকার মানুষ অতিষ্ট। এলাকাবাসী গত সপ্তাহে রুপার বিরুদ্ধে আবারও ঐক্যবদ্ধ হয়। এ নিয়ে উত্তেজনা দেখে বিষয়টি ডোমার থানার ওসিকে মোবাইলে জানালে তিনি উলটা আমাকে ধমক দেন। ওসি বলেন, আপনি ও এলাকাবাসী রূপার বাড়িতে কোনো মব সৃষ্টি করলে এতে কোনো সমস্যা হলে টার দায় আপনাকে নিতে হবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) উপজেলা সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ আইয়ুব বলেন, মাদকের কারণে আমরা এই এলাকার মানুষ সমাজে একেবারে ঘৃণিত হয়ে গেছি। তাই বাধ্য হয়ে এই এলাকার মানুষ ওসির  অপসারণের দাবিতে ঝাড়ু নিয়ে মাঠে নেমেছে। কারণ এসব দেখার জন্য যার দ্বায়ীত্ব ওসি ও প্রশাসন তারা একেবারে নিশ্চুপ। প্রশাসন মাসোয়ারার বিনিময়ে অপরাধীদের সহযোগীতা করছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।

ডোমার থানার ওসি মো. আরিফুল ইসলাম জানান, কারো পাকা ধানে মই দিয়ে ক্ষতি করিনি। কেন যে আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে পেছনে লেগেছে সেটা বুঝলাম না। বদলীর চাকরি করি সময় হলে যেকোনো সময় চলে যেতে হবে।

ডোমার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শায়লা সাঈদ তন্বী জানান, এলাকাবাসী ডোমার থানার ওসি আরিফুল ইসলাম বিরুদ্ধে শাস্তি ও অপসারণের দাবির একটি লিখিত অভিযোগ নীলফামারী পুলিশ সুপার বরাবর পৌঁছানোর জন্য জমা দেওয়া হয়েছে। সার্কেল ওসিকে বিষয়টি অবগত করেছি এবং নীলফামারী পুলিশ সুপারের নিকট অভিযোগটি রবিবার পাঠানো হবে।

নীলফামারী পুলিশ সুপার এ.এফ.এম তারিক হোসেন খান জানান, অভিযোগ ডোমারের ইউএনও’র মাধ্যমে দিয়েছে। এখনো হাতে পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সারাবাংলা/ইআ

অপসারণের দাবি ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ ডোমার থানার ওসি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর