Sunday 21 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘সততার আড়ালে’ ভয়ংকর দুর্নীতি
পাচার করা টাকায় ৯ দেশে বিশাল সাম্রাজ্য জাবেদের

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২২:০৭

সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একবার প্রতিমন্ত্রী ও আরেকবার পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী হিসেবে ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রামের সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। ক্ষমতার চেয়ারে থাকা অবস্থায় নিজেকে ‘সৎ ও নিষ্কলুষ’ সাজাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে তাকে নিয়ে ‘বোমা ফাটায়’ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি তখন নাম উল্লেখ না করে বলেছিল, এক মন্ত্রীর বিদেশে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার ব্যবসা আছে, যা তিনি নির্বাচনি হলফনামায় উল্লেখ করেননি। জাবেদ সেটা নিজের গায়ে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, এক টাকার দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেবেন।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদই ছিলেন ‘দুর্নীতির বরপুত্র’। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এরই মধ্যে বিশ্বের নয়টি দেশে জাবেদ ও তার স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের বাড়ি-গাড়ি, প্লট-ফ্ল্যাটসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য উঠে এসেছে।

জাবেদের মাত্র ২৫ কোটি টাকা পাচারের একটি মামলা তদন্তে নেমে দুদক ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ বের করে এনেছে। দুদক জানিয়েছে, প্রথম ধাপে চার দেশে- যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, দুবাই ও সিঙ্গাপুরে জাবেদের সম্পদের তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। সর্বশেষ আরও পাঁচ দেশে তার সম্পদ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলো হলো- ভারত, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া।

মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মশিউর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমে আমরা শুধু চারটি দেশে উনার (সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ) সম্পদের তথ্য পেয়েছিলাম। এখন দেখা যাচ্ছে, আরও চার/পাঁচটি দেশে উনার সম্পদ আছে। অর্থাৎ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উনার সম্পদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমরা এসব বিষয় আরও বিশদভাবে তদন্ত করছি।’

সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ প্রয়াত শিল্পপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর বড় ছেলে। তাদের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায়। সেখান থেকে বাবু একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাবেদ প্রথমে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হিসেবে পারিবারিক ব্যবসা আরামিট গ্রুপ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড দেখাশোনা করতেন। ব্যবসায়ী সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতিরও দায়িত্ব পালন করেন। তার বাবাও একই সংগঠনের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।

২০১২ সালে আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মৃত্যুর পর সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের রাজনীতিতে অভিষেক হয়। সরাসরি সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন পেয়ে ‘খালি মাঠে গোল দেন’। এরপর ২০১৪ সালে ও ২০১৮ সালে দু’বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৪ সালে আবারও মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে টিআইবি তার ‘ভালো মানুষের’ জারিজুরি ফাঁস করে দেওয়ায় মন্ত্রিসভায় আর জায়গা হয়নি।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগেই সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে লন্ডনে তার অবস্থানের তথ্য প্রকাশ হয় গণমাধ্যমে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দুদক তার বিপুল পরিমাণ সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে। এর পর জাবেদের নিজ মালিকানাধীন ব্যাংক ইউসিবিএল থেকে লুটপাট, বিদেশে টাকা পাচার ও বিভিন্ন দেশে সম্পদ গড়ার একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসতে থাকে।

দুদকের উপপরিচালক মশিউর রহমান জানান, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের বিরুদ্ধে ১৪০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে মানিলন্ডারিং আইনে এরই মধ্যে ছয়টি মামলা করেছে দুদক। তার বিষয়ে আরও অভিযোগ তদন্তনাধীন আছে। এসব মামলায় জাবেদের স্ত্রী রুকমিলা জামানসহ পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্য আসামি হিসেবে আছেন।

এর মধ্যে গত ২৪ জুলাই একটি মামলা হয়েছে ইউসিবিএল ব্যাংক থেকে ২৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচারের অভিযোগে। আসামি জাবেদ ও তার স্ত্রী রুকমিলাসহ ৩১ জন। মামলার তথ্যানুযায়ী, সেই ঋণ নিতে গিয়েও জাবেদ জালিয়াতির আশ্রয় নেন। নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আরামিট গ্রুপের কর্মচারীকে নামসর্বস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক সাজিয়ে নেওয়া হয় ঋণ। সেই ঋণ আরও কয়েকটি নামসর্বস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। এর পর সেই টাকা পাচার করা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

ওই মামলা তদন্তে নেমে গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে আরামিট গ্রুপের দুই সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) আব্দুল আজিজ ও উৎপল পালকে নগরীর ডবলমুরিং থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে দুদকের টিম। এর পর তাদের আদালতের নির্দেশে পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

দুদকের তথ্যানুযায়ী, এদের মধ্যে আরামিট গ্রুপের এজিএম (ফিন্যান্স) উৎপল পাল সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে বিদেশের সম্পদ অর্জন ও দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। উৎপল দেশ থেকে দুবাই ও দুবাই থেকে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে জাবেদের পরিবারের অর্থ পাচার প্রক্রিয়ার মাস্টারমাইন্ড।

অন্যদিকে আব্দুল আজিজ আরামিট থাই অ্যালুমিনিয়ামের এজিএম হিসেবে জাবেদের সম্পদ কেনা-বেচা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। গ্রেফতার আব্দুল আজিজ মামলাটির এজাহারভুক্ত আসামি। আর দুদকের তদন্তে অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা উঠে আসায় উৎপলকে গ্রেফতার করা হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মশিউর রহমান সারাবাংলাকে জানান, রিমান্ডে আজিজ ও উৎপলকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আজ রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) ভোরে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা এলাকার সিকদার বাড়ি থেকে ২৩ বস্তা নথিপত্র জব্দ করা হয়। বাড়িটি জাবেদের স্ত্রী ইউসিবিএল’র সাবেক চেয়ারম্যান রুকমিলা জামানের গাড়িচালক মো. ইলিয়াছের।

তিনি বলেন, ‘২৩ বস্তা নথিপত্র সবই আমাদের মামলার আলামত। এগুলো হচ্ছে বিদেশে থাকা সম্পদের দলিল, ভাড়া আদায়ের নথিপত্র। আমরা গত ১৮ সেপ্টেম্বর এসব আলামতের খোঁজে একবার অভিযান চালিয়েছিলাম। টের পেয়ে আগেই ইলিয়াছ সেগুলো তার প্রতিবেশি ওসমান তালুকদারের বাড়িতে সরিয়ে রাখেন। গত (শনিবার) রাতে আমরা অভিযানে গিয়ে দু’টি ঘরই তালাবদ্ধ দেখতে পাই। আজ (রোববার) ভোরে তালা ভেঙে আমরা ২৩ বস্তা নথিপত্র জব্দ করি।’

নথিপত্র প্রাথমিক যাচাইবাছাইয়ের পর মশিউর রহমান বলেন, ‘আমরা জাস্ট কিছু সম্পদের নাম পেয়েছি। দেখা যাচ্ছে, ইন্ডিয়াতে তার তিনটা সম্পদ আছে। মালয়েশিয়ায় দুইটা, থাইল্যান্ডে চার-পাঁচটা সম্পদ আছে। এভাবে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ায়ও কিছু কিছু সম্পদ জাবেদের নামে পাওয়া গেছে। এর আগে, আমরা যুক্তরাজ্যে তার ৩৪৩টা সম্পদ পেয়েছিলাম। আমেরিকায় পেয়েছি ১০টা সম্পদ। দুবাইতে পেয়েছি ২২৮টা সম্পদ। সব মিলিয়ে আগের চারটাসহ কমপক্ষে নয়টি দেশে এ পর্যন্ত তার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।’

দুদক কর্মকর্তারা জানান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, দুবাই ও সিঙ্গাপুরে জাবেদ ও তার স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের নামে মোট ৫৮২টি সম্পদের (প্লট, ফ্ল্যাট) তথ্য পাওয়া গেছে। ভারত, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়ায় আরও সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া, দেশে-বিদেশে ক্রয়কৃত ভাড়ার আয়, মেইনট্যানেন্সসহ বিভিন্ন তথ্যসহ নথিপত্র উদ্ধার করা ২৩ বস্তায় পাওয়া গেছে।

এর মধ্য দিয়ে সাবেক সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ দেশ থেকে টাকা পাচার করে বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়েছেন বলে প্রমাণ হয়েছে বলে দুদক কর্মকর্তাদের ভাষ্য।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

৯ দেশে সম্পদ সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ সাবেক ভূমিমন্ত্রী

বিজ্ঞাপন

মশক নিধনে ডিএসসিসি’র চিরুনি অভিযান
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২১:৫৪

আরো

সম্পর্কিত খবর