ঢাকা: ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়ে অনেককে হত্যা ও জখম করে পুলিশ। এমনকি আহতদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সেও গুলি করা হয়। জবানবন্দিতে এমনটিই উল্লেখ করেছেন ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ বাংলাদেশ) আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ।
রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দেওয়া জবানবন্দিতে এ কথা উল্লেখ করেন তিনি।
জুনায়েদ বলেন, “কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন পুনর্বহালের জন্য গতবছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারকে আল্টিমেটাম দেন আন্দোলনকারীরা। ১ জুলাই গঠিত হয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি দেওয়া হয়। ৬ জুলাই থেকে দেওয়া হয় ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। কিন্তু ১০ জুলাই হাইকোর্ট বিভাগের আদেশের ওপর স্থিতাবস্থা দেন আপিল বিভাগ। তবে ১৪ জুলাই রাষ্ট্রপতির কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন পুনর্বহালের দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। ওইদিন একটি সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ব্যঙ্গ করে শেখ হাসিনা বলেন- ‘চাকুরি মুক্তিযোদ্ধারের সন্তানরা পাবে না, তো কি রাজাকারের বাচ্চা ও রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?’। এর প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার-রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ স্লোগান দিয়ে সারারাত প্রতিবাদ করতে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা।”
তিনি বলেন, “১৫ জুলাই ‘আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দমনে ছাত্রলীগই যথেষ্ট’ বলে হুমকি দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল ইসলাম শয়ন বলেছিলেন, ‘ছাত্রলীগ ফুঁ দিলে আন্দোলনকারীরা পাঁচ মিনিটেই উড়ে যাবে’। একই দিন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম বলেছিলেন ‘আন্দোলন যাবে, আন্দোলন আসবে। কিন্তু ছাত্রলীগ থাকবে ও সবকিছু মনে রাখা হবে’। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর নির্মমভাবে সশস্ত্র হামলা চালায় ছাত্রলীগ। আহতদের হাসপাতালে যেতেও বাধা দেওয়া হয়। এমনকি হাসপাতালে চিকিৎসায়ও বাধা দেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এছাড়া, হাসপাতালে চিকিৎসারত আহত ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈকতের নেতৃত্বে হামলা চালানো হয়। এর প্রতিবাদে ১৬ জুলাই দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়।”
তিনি আরও বলেন, ‘ওই দিন কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সমবেত হন শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলায় রংপুরে আবু সাঈদ, চট্টগ্রামে ওয়াসিম, শান্ত, ফারুকসহ ছয়জনের শহীদ হওয়ার খবর পাওয়া যায়। ওইদিনই বন্ধ ঘোষণা করা হয় সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একইসঙ্গে পরদিন সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় প্রশাসন। আগের দিনের ঘটনার প্রতিবাদে ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলের আয়োজন করা হয়। গায়েবানা জানাজার আগেই রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনকে গ্রেফতারসহ কফিন মিছিলে হামলা চালায় পুলিশ। ১৮ জুলাই আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়ে অনেককে হত্যা ও জখম করে পুলিশ। এছাড়া, আহতদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সেও গুলি করা হয়। সেদিন রাতেই বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট সেবা।’
এই সাক্ষী আরও বলেন, ‘১৯ জুলাই আমি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকাধীন চিটাগাং রোডে আন্দোলনে ছিলাম। সকালে গাড়িবহর নিয়ে আসেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। বিকেল ৪টার সময় মা ও শিশু হাসপাতালের সামনে পুলিশের গুলিতে দুজন নিহত হন। আহত হন আরও কয়েকজন। এতে আন্দোলনকারীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে মিছিল করতে থাকেন। চিটাগাং রোডের ভূমি পল্লির সামনে বিজিবির হেলিকপ্টার থেকে মিছিলের ওপর গুলি চালানো হয়। সামনে থেকে র্যাব-পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরাও গুলি চালান। এতে ২০-২৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ও আহত হন। আর আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাই। সেখানে টানা তিন ঘণ্টা গুলি চলে। ওই রাতে বাসায় বাসায় গিয়ে আন্দোলনকারীদের খুঁজতে থাকে পুলিশ ও ছাত্রলীগ। একই দিন রাতে কারফিউ জারি করা হয়।’
জুনায়েদ বলেন, ‘২০ জুলাই সকালে আমরা কারফিউ ভেঙে ফের রাস্তায় বেরিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাই। কর্মসূচির ৯ দফা নির্ধারণ করে পেনড্রাইভে বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে পাঠানো হয়। তবে আন্দোলন থামানোর জন্য সমন্বয়কদের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। যেহেতু ২১ জুলাই কোটা সংস্কার বিষয়ে আপিল বিভাগে একটি আদেশ হওয়ার কথা রয়েছে, সেহেতু ছাত্রদের আন্দোলন বন্ধ করতে বলা হয়। তবে ২১ জুলাই ৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেখানে গণহত্যার দায় স্বীকার করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার পাশাপাশি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ দুজন মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়।’
আপ বাংলাদেশের এই আহ্বায়ক বলেন, ‘আন্দোলন চলাকালীন যাত্রাবাড়ী থেকে চিটাগাং রোড এলাকায় শতাধিক ব্যক্তি নিহত হন। আহত হন কয়েক শতাধিক। এ সময়ের মধ্যে প্রায় ১৩৪ জনের লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে রায়ের বাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়। প্রথমে নাহিদ ইসলামকে গুম করে রেখে ২১ জুলাই মুক্তি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তাকেসহ ছয় সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজতে তুলে নেওয়া হয়। ওই সময় গণগ্রেফতার চলতে থাকে। দুই শতাধিক মামলায় আসামি করা হয় প্রায় দুই লক্ষাধিক ব্যক্তিকে। এছাড়া, ৩০ জুলাই শোক ঘোষণা করে সরকার। তবে আমরা প্রত্যাখ্যান করে চোখে-মুখে লাল কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ কর্মসূচি দিই। একইসঙ্গে ফেসবুক প্রোফাইল লাল করার আহ্বান জানাই। এ কর্মসূচিতে ব্যাপক সাড়া পড়ে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইল লাল হয়ে যায়।’
তিনি বলতে থাকেন, “গণগ্রেফতারের প্রতিবাদে আদালত অভিমুখে ৩১ জুলাই ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করা হয়। এ কর্মসূচিতে বাধা দেয় পুলিশ। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শেহরিন আমিন মোনামিসহ অনেকেই আহত হন। ১ আগস্ট ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালন করা হয়। একইসঙ্গে আমরা ১ আগস্ট তারিখকে ৩২ জুলাই হিসেবে গণনার সিদ্ধান্ত নিই। পরবর্তী আগস্টের ৫ তারিখ পর্যন্ত ৩৬ জুলাই হিসেবে গণনা করা হয়। ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে সরকার পতনের এক দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন নাহিদ ইসলাম। আমিসহ আরও অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলাম। ৪ আগস্ট যাত্রাবাড়ী এলাকায় আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাই। সেদিন সম্মিলিতভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ। এতে অনেকেই হতাহত হন। ওই দিন প্রথমে ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। তবে সমন্বয়ক আসিফ ও সাদিক কায়েমের সঙ্গে কথা বলে আমি কর্মসূচি এগিয়ে আনার পরামর্শ দিই। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৪ আগস্ট রাতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি একদিন এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট করার ঘোষণা দেন সমন্বয়ক আসিফ।’
জুনায়েদ বলেন, ‘৫ আগস্ট সকাল ৯টায় আমি বাসা থেকে বের হয়ে আন্দোলনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রাবাড়ীর দিকে রওনা হই। আমার সঙ্গে আরও সাত-আটজন ছিলেন। সাদ্দাম মার্কেটের সামনে অনেক আন্দোলনকারী জড়ো হন। আমিও যুক্ত হই। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে আমরা কাজলা ফুটওভার ব্রিজের সামনে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাই। ওই সময় আন্দোলনকারীদের ওপর স্নাইপার রাইফেল দিয়ে টার্গেট করে মাথায় গুলি করা হয়। আমি প্রায় ১৫ জনকে মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় অনাবিল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে দেখেছি। এক পর্যায়ে ২টার দিকে জাতির উদ্দেশে সেনাপ্রধান ভাষণ দেবেন বলে আমরা জানতে পারি। এতে শেখ হাসিনা সম্ভবত ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে বলে আমরা ধারণা করতে পারি। তবে আমি হ্যান্ডমাইকে আন্দোলনকারীদের মাঠ না ছাড়ার অনুরোধ জানাই। যেন দেশে সামরিক শাসন আসতে না পারে সেজন্য সজাগ থাকতে। বিকেল ৩টায় শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন বলে ঘোষণা দেন সেনাপ্রধান। সেদিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী থানার আশপাশ থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ।’
জুনায়েদ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ জড়িত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিচার চান ট্রাইব্যুনালের কাছে।