ঢাকা: গত বছরের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর বোম্বিংয়ের নির্দেশ দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাবেক মন্ত্রী জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর ফোনালাপে এমনটিই শুনেছেন বলে জবানবন্দিতে জানিয়েছেন শহিদ মাহামুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী।
জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ২০তম কার্যদিবসের মতো সাক্ষ্যগ্রহণ ছিল আজ (২২ সেপ্টেম্বর)। এদিন ৪৯তম সাক্ষী হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাবরিনার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নুরজাহান রোডের দক্ষিণ মাথায় আন্দোলনে অংশ নেন সৈকত। সেখানেই তাকে গুলি করে পুলিশ। পরে আন্দোলনকারীরা সৈকতকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
জবানবন্দিতে সাবরিনা বলেন, ওই দিন খবর পেয়ে আমি হাসপাতালে যাই। সেখানে আমার ভাইয়েরসহ পাঁচজনের লাশ দেখতে পাই। সৈকতের মাথায় গুলি লেগেছিল। এজন্য মাথায় মোটা রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ দেখেছিলাম। বাকি সব লাশের মাথায়, পেটে-বুকে গুলির চিহ্ন দেখি। আমি হাসপাতালে প্রায় আধাঘণ্টা ছিলাম। এ সময়ের মধ্যে অনবরত গুলিবিদ্ধ আন্দোলনকারীদের হাসপাতালে আনা হচ্ছিল। এছাড়া হাসপাতালের মেঝেতে অনেক রক্ত ছিল, যা আমার ভাইয়ের মাথা থেকে নির্গত হওয়া। সেই রক্ত একজন ব্যক্তিকে বালতি দিয়ে পানি ঢেলে ধুতে দেখেছি। একপর্যায়ে সৈকতের লাশ দেখে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি।
তিনি বলেন, আমার মা বাসায় একা ছিলেন। এজন্য ফুফাতো ভাই সাইফুর রহমান হায়দারকে হাসপাতালে রেখে আমি বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হই। ওই দিন রাত ৯টার দিকে হাসপাতাল থেকে সৈকতের লাশ বুঝে পান তিনি। পরদিন ২০ জুলাই জানাজা শেষে মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডে অবস্থিত জামে মসজিদ কবরস্থানে আমার ভাইকে দাফন করা হয়। তখনও আন্দোলন চলমান ছিল। প্রতিনিয়ত আন্দোলনকারীদের হত্যা করা হচ্ছিল।
সাক্ষী আরও বলেন, ৫ আগস্ট জনশ্রোতের মুখে পদত্যাগ করে পালিয়ে যান স্বৈরাচারী, খুনি ও অবৈধভাবে নির্বাচিত তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। পালিয়ে যাওয়ার কিছু মাস পর আমি শেখ হাসিনার কিছু ফোন রেকর্ড শুনতে পাই। আমার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিল আল-জাজিরা। সাক্ষাৎকারের সময় আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি মাকসুদ কামালের সঙ্গে শেখ হাসিনার ফোনালাপ শোনান আল-জাজিরার সাংবাদিক। সেই ফোনালাপে আন্দোলনকারীদের রাজাকার আখ্যায়িত করে ইংল্যান্ডের স্টাইলে স্টুডেন্টদের হত্যা করা হবে বলেছেন শেখ হাসিনা। অপর ফোনালাপে মেয়র তাপসকে শেখ হাসিনা ড্রোন ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের অবস্থান নির্ণয়পূর্বক লিথাল ওয়েপন বা মারণাস্ত্রে হত্যার নির্দেশ দেন। ওই কথোপকথনে মোহাম্মদপুর এলাকার কথা উল্লেখ করেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। আর মোহাম্মদপুরেই পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়েছেন আমার ভাই।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে শেখ হাসিনার আরেকটি ফোনালাপ শুনতে পাই। ওই ফোনালাপে শেখ হাসিনা জানান, তিনি শিক্ষার্থীদের ওপর বোম্বিংয়ের নির্দেশ দিয়েছেন।আমার ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে খুনি হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দায়ী করছি। একইসঙ্গে নির্দেশ মেনে নিরস্ত্র-নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহার করে যারা নিহত-আহত করেছেন, তাদের দায়ী করছি। তাদের বিচার ও ফাঁসি চাই।
সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে সাবরিনাকে জেরা করেন শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় ২০তম কার্যদিবসে এখন পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন ৪৯ জন। তবে সাধারণ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ এখানেই শেষ বলে জানিয়েছে প্রসিকিউশন। পরবর্তীতে নেওয়া হবে জব্দ তালিকার সাক্ষী ও তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, প্রসিকিউটর তারেক আবদুল্লাহ ও মামুনুর রশীদ।
এদিকে, আজ সকালেও ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলার অন্যতম আসামি থেকে রাজসাক্ষী হয়ে জবানবন্দি দেওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে। তার উপস্থিতিতেই জবানবন্দি দিচ্ছেন সাক্ষীরা।