নেত্রকোনা : নেত্রকোনার ‘মাছের ভাণ্ডার’ বলে পরিচিত হাওর অঞ্চল এখন মাছের সংকটে। একসময় এখানে প্রচুর দেশি মাছের দেখা মিলত। এখন আর সেসব মাছ খুব একটা দেখা যায় না। সুস্বাদু দেশীয় প্রজাতির এসব মাছ জেলেদের জালেও ধরা পড়ছে খুব কম।
আগে এখানকার মাছ রাজধানীসহ বড় বড় শহরে জোগান দিত, কিন্তু এখন স্থানীয় চাহিদাও মেটে না। বর্তমানে বাতাই, চান্দা, কালো শোলসহ প্রায় ৭৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে, যার ফলে দেশি মাছে তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতির কারণে স্থানীয় জেলে পরিবারগুলো চরম বিপাকে পড়েছেন।
অন্যদিকে, বাজারে দেশি মাছের সরবরাহ কমায় দাম বেড়েছে কয়েক গুন। এতে নিম্ন আয়ের ক্রেতারাও আছেন ভোগান্তিতে। জলমহল দখল এবং নিষিদ্ধ সময়ে মাছ শিকারের মতো বিভিন্ন অনিয়মের কারণেই ঐতিহ্যবাহী এই মাছের ভাণ্ডারে আজ বিরাট ‘শূন্যতা’।
জেলায় ১০টি উপজেলায় ৪৭টি নদ-নদী, ১৩৪টি হাওর এবং অগণিত পুকুর রয়েছে। খাল-ডোবার নির্দিষ্ট হিসাব না থাকলেও, এই উন্মুক্ত জলাশয়গুলো থেকেই প্রায় অর্ধেক পরিমাণ মাছ উৎপাদিত হয়। বাকি অর্ধেক আসে বিভিন্ন খামার থেকে। উদ্বেগজনকভাবে, এসব জলাশয়ে দেশীয় প্রজাতির মাছ দিনদিন কমে যাচ্ছে, আর তার স্থান দখল করছে হাইব্রিড জাতের মাছ।
জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার হাওর অঞ্চল থেকে দেশি জাতের অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-বাতাই, চান্দা, দারকিনা, নানিদ, কালো শোল, কালবাউস, কললা, পাতলা বাচা, ভেদুরি, সুন্দরী, বাকমাছ, নাপিত মাছ, গুতুমসহ প্রায় ৭৫ প্রজাতির মাছ। দেশি মাছের এই বিলুপ্তির ফলে জেলা শহরসহ সব উপজেলার বাজারে মাছের সরবরাহ মারাত্মকভাবে কমেছে, যার কারণে বিভিন্ন জাতের মাছের দামও অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
মোহনগঞ্জের ডিঙ্গাপোতা হাওর পাড়ের জেলে যতীন মাঝি জানান, একসময় বর্ষাকালে ডিঙ্গাপোতা হাওরে বোয়াল, কাতল, রুই, বাইম, গুলশা, বাচাসহ নানা মাছের দেখা মিলত। জেলেরা তখন সেই মাছ মোহনগঞ্জ বাজারে বিক্রি করে পরিবারের খরচ চালানোর পাশাপাশি টাকা সঞ্চয়ও করতে পারতেন। কিন্তু দেশি মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় এখন তাদের অবস্থা খুবই করুণ।
মোহনগঞ্জ মেছুয়া বাজারের মাছ আড়তের মালিক সামছুল হক জানান, দেশের মিঠা পানির মাছের জন্য বিখ্যাত এই বাজারে প্রায় অর্ধেক পরিমাণ দেশিয় মাছ কমে গেছে। ধীরে ধীরে এই বাজারের দখল নিচ্ছে বিদেশি হাইব্রিড মাছ।
মোহনগঞ্জ বাজারের ক্রেতা গোলাম মোস্তফা বলেন, দেশি মাছের স্বাদ ছিল প্রচুর। অন্যদিকে হাইব্রিড মাছের স্বাদ তেমন নেই, অথচ এর সরবরাহ বাড়ছে। চাহিদা বেশি থাকায় দেশি মাছের দাম বেড়েছে।
খালিয়াজুরী বাজারের বাসিন্দা অনিল সরকার অভিযোগ করে বলেন, হাওর অঞ্চলে একদিকে ‘ভোটের রাজনীতি’ চলছে, অপরদিকে চলছে জলমহল দখল করে দলীয় লোকদের মাছ শিকারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার প্রতিযোগিতা। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সাধারণ জেলেরা দীর্ঘদিন ধরে জলমহল ইজারা নেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হুমকি-ধামকি ও নির্যাতনের ভয়ে কেউ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহসও পান না।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মাহফুজা বেগম জানান, জেলার হাওর অঞ্চলে পোনা ও মাছ শিকার নিষিদ্ধ হলেও অনেকে তা মানছেন না, উপরন্তু শীতকালে উন্মুক্ত জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা হয়। তিনি দেশীয় মাছের উৎপাদন বাড়াতে সকলের সহযোগিতা এবং পুকুর ও খামারে হাইব্রিড মাছের পাশাপাশি দেশি মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। তিনি আরও বলেন, অনিয়ম ও নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশীয় প্রজাতির মাছ উৎপাদনের গুরুত্ব উপলব্ধি করা সবচেয়ে জরুরি। এর জন্য মাছ চাষীদেরই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে, আর এ বিষয়ে তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ অবশ্যই দেওয়া হবে।