ঢাকা: ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের ফসল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং ’৬৯-এ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় লীগকে (বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় লীগ) নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে এনসিপি আলোচনায় থাকলেও ইসির নিবন্ধন পেতে যাওয়া ‘বাংলাদেশ জাতীয় লীগ’র বিষয়ে জানেন না অনেকেই। কারণ, এর আগে দলটি একাধিক নির্বাচনে অংশ নিলেও ’৯০ দশকের পর ঝিমিয়ে পড়ে।
জানা গেছে, ’৬৯-এ গঠিত দলটি ১৯৭০, ১৯৭৩ ও ১৯৭৯ সালে নির্বাচনে অংশ নেয়। এমনকি ১৯৮৪ সালে দলীয় প্রধান আতাউর রহমান তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এএইচএম এরশাদের নির্বাহী আদেশে গঠিত মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আলোচনার জন্ম দেন। কিন্তু এতদিন পর দলটি ফের নিবন্ধন নিয়ে রাজনীতির মাঠে ফিরতে চাওয়ায় অনেকের মাঝেই প্রশ্ন- ‘বাংলাদেশ জাতীয় লীগে’ কারা সম্পৃক্ত, বা বর্তমানে নেতৃত্বে আছেন কারা?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সারাবাংলার প্রতিবেদক কথা বলেন ‘বাংলাদেশ জাতীয় লীগ’র বর্তমান চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলমের। তিনিই জানান দলটির উত্থান থেকে শুরু করে আগামীর পথচলা নিয়ে। মাহবুবুল আলম বলেন, ‘১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে জাতীয় লীগ গঠিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় লীগের হয়ে ঢাকা-১৯ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সেসময় দলটির প্রতীক ছিল লাঙ্গল। এর পর ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-২১ আসন থেকে সংসদ সদস্য হন। একই নির্বাচনে মফিজুল ইসলাম কুমিল্লা থেকে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হন।’
জানা গেছে, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ১৯৮৩-৮৪ সালে সাত দলীয় জোটের অন্যতম সদস্য ছিল, যারা এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিল। কিন্তু ’৮৪ সালে হঠাৎ-ই মত পরিবর্তন করে এরশাদের নির্বাহী আদেশে গঠিত মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ জাতীয় লীগর চেয়ারম্যান আতাউর রহমান। এর পর দলীয় সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নারী নেত্রী আমেনা বেগম দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত দলের চেয়ারম্যান ছিলেন। ’৮৯ সালের পর চেয়ারম্যান হন অ্যাডভোকেট আব্দুস সোবহান। এর পর ছিলেন মোজাহিদুল ইসলাম। তার মৃত্যুর পর আজহার আলী হাওলাদার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি মৃত্যুবরণ করলে ২০১১ সালে মাহবুবুল আলম দলটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন।
নিবন্ধনের বিষয়ে মাহবুবুল আলম বলেন, ‘২০১৭ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য প্রথম নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছিলাম। এর পর ২০২২ সালেও ফের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করি। কিন্তু নানাবিধ কারণে নিবন্ধন মেলেনি। সবশেষ ২০২৫ সালের ২০ এপ্রিল ফের আবেদন জমা দিই। আবেদনের সব শর্ত পূরণ করায় এবার আমরা নিবন্ধন পেতে যাচ্ছি। দীর্ঘদিন পথচলার পর আমাদের দল ইসির নিবন্ধন পাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য খুশির খবর।’
দলীয় প্রতীক নিয়ে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, “আগে আমরা যখন আবেদন করেছিলাম তখন আমরা ‘কলার ছড়ি’ চেয়েছিলাম। পরে দেখলাম ইসিতে নতুন প্রতীক যুক্ত হয়েছে। এখন আমরা ‘কলার ছড়ি’ পরিবর্তন করে অন্য প্রতীকের জন্য আবেদন করব। তবে কী প্রতীক চাইব সেটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, “আমরা আমাদের আগের ‘লাঙ্গল’ প্রতীকেরও হকদার। তবে ‘লাঙ্গল’র জন্য আবেদন করব, নাকি অন্য নতুন প্রতীক চাইব- সেটা পরবর্তী দলীয় সভায় চূড়ান্ত করা হবে।”
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পাওয়া নতুন দেশে আমরা আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন চাই। তবে আমরা দলীয়ভাবে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই না। গণতান্ত্রিক ধারাতে বিদ্যমান আইনেই নির্বাচন চাই।’
দলটির আগামীর পথচলা বিষয়ে জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমান প্রজন্ম দেশের ইতিহাস জানে কম। দেশের জন্য অবদান রাখা জাতীয় নেতাদের বিষয়ে সকলের জ্ঞান থাকা উচিত। আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা আতাউর রাহমান খান ১৯৮৪ সালে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এছাড়াও পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনেও আতাউর রহমানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।’
আগামীতে দলের নানান কর্মসূচির কথা জানিয়ে জাতীয় লীগের চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দলের সব নেতারা অংশ নিয়েছে। তাই দলের গঠনতন্ত্রে ‘জুলাই ২৪’ এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রেখেই আগামীর পথচলা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই চেতনাকে ধারণ করেই আমরা আগামীতে পথ চলতে চাই।”
এর আগে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানান, নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা পড়েছিল ১৪৩টি। এর পর ২২টি দলের মাঠপর্যায়ে তথ্য পর্যালোচনা করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগ নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করেছে।
আইন অনুযায়ী, ইসির নিবন্ধন পেতে হলে দলের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি, এক তৃতীয়াংশ জেলা ও ১০০টি উপজেলা কমিটি থাকতে হয়। এছাড়া, প্রতিটি কমিটিতে ২০০ ভোটারের সমর্থনের প্রমাণ থাকতে হয়। তবে অন্য দল থেকে আসা কেউ আগে সংসদ সদস্য থাকলে বা আগের নির্বাচনে পাঁচ শতাংশ ভোট পেলেও নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্যতা হিসেবে ধরে থাকে ইসি। এই প্রধান শর্তগুলো ছাড়াও বেশকিছু নিয়ম কানুন মেনে আবেদন করতে হয়।