সিলেট: বাজছে নির্বাচনি হুইসেল। প্রতিযোগীরা সব মাঠে। কেউ কেউ দলের ভেতর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত, কেউ আবার অন্য দলের প্রার্থীর সঙ্গে; কাউকে দেখা যাচ্ছে কেন্দ্র সামলাতে ব্যস্ত। তবে এই মুহূর্তে বড় দলগুলোর প্রার্থীরা নিজ দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোকাবিলা করছেন। আর এর জন্য মিছিল-মিটিংয়ের শোডাউন নিয়ে ব্যস্ত তারা। মাঠ যার, প্রার্থিতা তার— এমন সমীকরণ দাঁড় করাতে গিয়ে নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়াচ্ছেন।
সম্প্রতি এমন ঘটনা ঘটেছে সিলেট-২ আসনে (বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর উপজেলা)। মাঠ দখলের রাজনীতিতে এই আসনের একদিকে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও নিখোঁজ নেতা এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদী লুনা, অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির। দু’জনই আসছে ত্রয়োদশ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেতে চায়। তাই মাঠে সক্রিয় উভয়পক্ষের নেতাকর্মীরা। তবে স্থানীয় বেশিরভাগ নেতাকর্মী বলছে, ‘ইলিয়াসের আসন মানেই লুনা আপা।’ আবার অপরপক্ষে হুমায়ুন কবির নিজেকে যোগ্য প্রমাণে মাঠে শোডাউন বাড়িয়েছে। এতে দু’পক্ষের মধ্যে ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘর্ষ। তাই সবমিলিয়ে সিলেট-২ আসন এখন রাজনীতির আলোচিত কেন্দ্রবিন্দু।
ইলিয়াস আলীর স্মৃতি ও লুনার রাজনৈতিক যাত্রা
সিলেট-২ আসনের রাজনীতি বলতে যে নামটি প্রথমেই উচ্চারিত হয়, সেটি হলো এম ইলিয়াস আলী। ২০১২ সালে তার রহস্যজনক নিখোঁজ হলেও এই আসনের রাজনীতিতে তার প্রভাব আজও প্রবল। ওই সময় থেকেই স্থানীয় নেতাকর্মীরা তার পরিবারের পাশে রয়েছেন। স্বামীর অনুপস্থিতিতে বিএনপি চেয়ারপারসনের নির্দেশে তাহসিনা রুশদী লুনা মাঠে নামেন, সংগঠনের হাল ধরেন, নেতাকর্মীদের আগলে রাখেন। ২০১২ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত মাঠে রয়েছেন তিনি। প্রতিকূলতা, ভয়ভীতি, সরকারি চাপ— সব পেরিয়ে লুনা একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর জুড়ে। দলের কর্মীরা তাকে শুধু নেতা নয়, ‘ইলিয়াস ভাইয়ের উত্তরাধিকারি’ হিসেবেও দেখেন। তাদের কাছে লুনা এখন প্রতিরোধ, দৃঢ়তা ও ত্যাগের প্রতীক।
সম্প্রতি সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে একান্ত আলাপে ইলিয়াসপত্নী লুনা বলেন, ‘ইলিয়াস আলী গুমের পর দলীয় চেয়ারপারসনের নির্দেশে আমি মাঠে নামি। এখনো মাঠেই আছি, কাজ করছি। নেতাকর্মীরা আমার পাশে রয়েছে। দল যদি আমাকে দায়িত্ব দেয়, আমি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করব।’ তার প্রতিপক্ষ হুমায়ুন কবির সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘বিএনপি সিলেট-২ আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করুক। তার পর আপনাদের কাছে সব পরিষ্কার হয়ে যাব।‘ তার বক্তব্যে একদিকে আত্মবিশ্বাস, অন্যদিকে অপেক্ষার সুর— দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি আনুগত্যও স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘এই আসনের মানুষ আমার সঙ্গে আছে। আমার স্বামীর অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব আমি নিতে চাই।’
লুনার জনপ্রিয়তা ও কর্মীদের আবেগ
ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই তার পরিবারকে ঘিরে একধরনের আবেগ তৈরি হয়েছে। স্থানীয়ভাবে অনেকেই বলেন—
‘ইলিয়াস ভাই নেই, কিন্তু লুনা আপা আছেন। আমরা তার জন্যই মাঠে নামব।’ বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগরে বিএনপির তৃণমূল নেতারা প্রায় একবাক্যে স্বীকার করেন, ‘লুনার হাত ধরেই সংগঠন এখনো টিকে আছে। তার নেতৃত্বে দুই উপজেলার বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলো একসঙ্গে কাজ করছে। দীর্ঘদিন ধরে কোনো বড় কোন্দল দেখা যায়নি।’ এমনকি দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাও মনে করেন, ‘ইলিয়াসের আসন অন্য কাউকে দিলে সেটা কর্মীদের মনে আঘাত হানবে।’
হঠাৎ মাঠে হুমায়ুন কবির
যখন সবাই মনে করেছিল লুনাই নিশ্চিত প্রার্থী, তখন গত আগস্টে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরে দৃশ্যপটে হাজির হন কেন্দ্রীয় বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির। তিনি সরাসরি ঘোষণা দেন, সিলেট-২ আসনে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে চান। দলীয় সূত্র বলছে, হুমায়ুন কবিরের এই সিদ্ধান্তে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভাজন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে তার শোডাউনকে ঘিরে ৯ অক্টোবর রাতে সংঘর্ষের ঘটনায় উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। উভয়পক্ষের নেতাকর্মীরা একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এতে স্পষ্ট হয়ে যায়— সিলেট-২ এখন দুই মেরুতে বিভক্ত; একপাশে লুনা, অন্যপাশে হুমায়ুন।
সংঘর্ষে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি
৯ অক্টোবর রাতে হুমায়ুন কবিরের শোডাউন চলাকালে তার অনুসারীদের সঙ্গে লুনাপন্থী কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হন বেশ কয়েকজন। এর পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। লুনাপন্থীরা প্রকাশ্যে বলছেন, ‘জীবন দিয়ে হলেও আমরা লুনা আপার জন্য কাজ করব। অন্য কাউকে এখানে চাই না।’ এই কঠোর মনোভাব দলীয় নেতৃত্বের জন্যও নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তৃণমূলের বিশাল একটি অংশ স্পষ্টতই লুনার পাশে, অন্যদিকে কেন্দ্রের একটি প্রভাবশালী অংশ হুমায়ুন কবিরকে প্রার্থী করতে আগ্রহী। ফলে সিলেট-২ আসন বিএনপির অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যের এক বড় পরীক্ষা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
২০১৮ সালের হতাশা ও লুনার প্রত্যাবর্তন
২০১৮ সালের নির্বাচনে লুনা বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নানা নাটকীয়তা, প্রশাসনিক চাপ ও রাজনৈতিক জটিলতায় তিনি প্রার্থী হতে পারেননি। সে সময় অনেকেই মনে করেছিলেন, এই ধাক্কা হয়তো তাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। কিন্তু বরং উলটোটা ঘটেছে। লুনা আরও শক্তভাবে মাঠে নেমেছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন গ্রামে গ্রামে, ইউনিয়নে ইউনিয়নে। কর্মীরা বলছেন, ‘যখন অনেকেই দেশ ছাড়ছেন, লুনা আপা তখন মাঠে।’
লুনার পক্ষে আবেগ, হুমায়ুনের পক্ষে কৌশল
রাজনীতির ভাষায় বলা যায়, লুনা মাঠের খেলোয়াড়, হুমায়ুন কৌশলবিদ। লুনার পক্ষে রয়েছে কর্মীদের হৃদয়ের সংযোগ, ত্যাগের প্রতীক ইমেজ ও ইলিয়াস আলীর উত্তরাধিকার। অন্যদিকে হুমায়ুন কবিরের পক্ষে রয়েছে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠতা, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও সংগঠনিক দক্ষতার সুনাম। তবে প্রশ্ন হলো—এ ই দুই শক্তি কি একসঙ্গে চলবে, নাকি সংঘর্ষ আরও বাড়বে?
প্রবাসী বিএনপির ভূমিকা ও প্রভাব
সিলেট-২ আসনের রাজনীতিতে প্রবাসীদের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। যুক্তরাজ্য প্রবাসী নেতাকর্মীরা সবসময়ই স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। লন্ডনে ইলিয়াস আলীর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। লুনাও সেই প্রভাবের ধারক। অন্যদিকে হুমায়ুন কবিরও প্রবাসী নেতা হিসেবে যুক্তরাজ্যে প্রভাবশালী। ফলে প্রবাসী বিএনপির একটি অংশ লুনার পক্ষে, অন্য অংশ হুমায়ুনের পক্ষে। আর এমন বিভাজন তৈরি হয়েছে লন্ডন পর্যন্ত।
কর্মীরা চায় ‘ধানের শীষ উঠুক লুনার হাতে’
বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগরের গ্রামাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, স্থানীয় ভোটারদের মধ্যে লুনা আলীর প্রতি গভীর সহানুভূতি রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, ‘ইলিয়াস ভাইয়ের জন্যই আমরা বিএনপি করি। তার স্ত্রী প্রার্থী হলে আবার প্রাণ ফিরে পাবে এই আসন।’ একই সুর দলের মহিলা ও যুব সংগঠনের মধ্যেও। তারা মনে করেন, ‘লুনা আপা শুধু প্রার্থী নন, তিনি প্রতিরোধের প্রতীক।’ এই আবেগকেই মূল শক্তি হিসেবে দেখছেন তাহসিনা রুশদী লুনা নিজেও।
বিএনপির সামনে কঠিন সমীকরণ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলীয় হাইকমান্ড এখন এক কঠিন অবস্থানে। একদিকে দীর্ঘদিন মাঠে থাকা লুনা, অন্যদিকে তরুণ, শিক্ষিত, আন্তর্জাতিক সংযোগসম্পন্ন হুমায়ুন কবির। দল যদি অভ্যন্তরীণ ঐক্য চায়, তাহলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে অত্যন্ত কৌশলে। কারণ, যেই পক্ষ বাদ পড়বে, তাদের ক্ষোভের প্রভাব পড়বে নির্বাচনের মাঠে। সিলেট-২ আসনে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে সেটার প্রভাব শুধু এই আসনে নয়, পুরো সিলেট বিভাগে পড়তে পারে।
উত্তেজনা এখন চরমে
দিন যতই এগোচ্ছে, সিলেট-২ আসনে উত্তেজনা ততই বাড়ছে। কর্মীদের চোখ এখন এক জায়গায়— ধানের শীষ কার হাতে যাবে? তাহসিনা রুশদী লুনা বলছেন, ‘তিনি প্রস্তুত, দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। অন্যদিকে হুমায়ুন কবিরও মাঠ ছাড়ছেন না। তার প্রচার, শোডাউন— সবই বলছে তিনি লড়তে এসেছেন। তবে মনোনয়ন প্রত্যাশী হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে কথা বলতে চাইলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তাকে মোবাইল ফোনে পাওয়া যায়নি।
সবশেষ বলা যায়, ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের এক দশকের বেশি সময় পার হলেও সিলেট-২ আসনের রাজনীতি আজও তার নামেই স্পন্দিত। সেই নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তাহসিনা রুশদী লুনা। অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান হুমায়ুন কবির। দুই প্রার্থীর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সবচেয়ে বড় আলোচ্য বিষয়। দলের মনোনয়ন বোর্ডের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে— আবেগ না কৌশল, মাঠ না মগজ— সিলেট-২ আসনে শেষ হাসি কে হাসবেন?