রংপুর: চোখে জল, মুখে হতাশা, বুকভরা অপেক্ষার চিত্র—এটিই যেন ‘রংপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল’র বারান্দার দৈনন্দিন বাস্তবতা। কেউ ধর্ষণের শিকার, কেউ গৃহনির্যাতনের, কেউবা যৌতুকের দাবিতে পিষ্ট। কিন্তু বছরের পর বছর ঘুরেও তারা বাড়ি ফেরেন শূন্য হাতে। বর্তমানে তিনটি ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে ধর্ষণ মামলা দেড় হাজারেরও বেশি। আইনি জটিলতা আর ধীরগতির প্রক্রিয়ায় এই মামলাগুলোর বেশিরভাগই যুগ যুগ ধরে ঝুলে আছে।
আইনজীবী বলছেন, তিন কারণেই বিচারকাজ বিলম্বিত হচ্ছে; এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাদী ও আসামি উভয় পক্ষ। ‘ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করে সরকারের করা নতুন আইন পাশ করলে দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব।
দীর্ঘ ৫ বছর ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কিশোরীর বাবা। শুধুমাত্র মামলা পরিচালনা করতে বিক্রি করতে হয়েছে জমি, পুকুর এবং সবশেষ মাথা গোঁজার ঠাইটুকুও। কথা বলেন সারাবাংলার সঙ্গে। তার কণ্ঠে ছিল অসহায়ত্ব, চোখে ছিল শূন্যতা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই অবিভাবক বলেন, ‘সহায় সম্বল যা ছিল, সব বিক্রি করে প্রতি তারিখে আদালতে আসি। উকিল, মুহুরি, পেশকার—সবাইকে টাকা দিই। তারপর নতুন তারিখ পড়ে। পাঁচ বছর ধরে শুধু খরচ করছি, কোনো বিচার পাইনি।’
রংপুরের আদালতের বারান্দায় সারাবাংলার প্রতিবেদকের সঙ্গে ভুক্তভোগীর কথোপকথন যে প্রতিটা ভুক্তভোগীর প্রতিদিনের জমে ওঠা একেকটি গল্প; যা অপেক্ষার, যন্ত্রণার, আর ন্যায়বিচারের আকুতি।

বিচার না পেয়ে আদালতের বারান্দায় বছরের পর বছর ঘুরছেন ভুক্তভোগীর স্বজনরা। ছবি: সারাবাংলা
নির্যাতনের শিকার মিঠাপুকুরের এক নারী জানান, ২০২১ সালে তার মেয়েকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল। মামলা করেছেন, কিন্তু চার বছরেও বিচার শুরু হয়নি।
বদরগঞ্জের আরেক নারী বলেন, ‘যৌতুক না দেওয়ায় স্বামী নির্যাতন করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। থানায় গেলে মামলা নেয়নি। ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছি পাঁচ বছর আগে। এখন মামলার খরচ চালানোই অসম্ভব হয়ে গেছে।’
ওপরের এই তিন ভুক্তভোগীর এইসব গল্প শুধু বিচ্ছিন্ন নয়, বরং প্রতিটি ট্রাইব্যুনালের প্রতিটি ফাইলের ভেতর লুকিয়ে আছে এমন শত শত কান্না, চাপা কষ্ট আর নিঃস্ব হয়ে যাবার গল্প। সম্প্রতি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩-এ বিচারক বদলি হওয়ার পর তিন মাস ধরে দেড় হাজারের বেশি মামলা অচল অবস্থায় পড়ে আছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারপ্রার্থীরা। ছবি: সারাবাংলা
রংপুর আদালতের জ্যৈষ্ঠ আইনজীবী রইছ উদ্দিন বাদশার মতে, তদন্তে কালক্ষেপণ, সাক্ষী হাজিরে পুলিশের অনীহা এবং আদালতে সময় নেওয়ার প্রবণতা—এই তিনটি কারণেই বিচারকাজ বিলম্বিত হচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাদী ও আসামি উভয় পক্ষ।
আদালতের বিশেষ পিপি মোকসেদুল হক জানান, ‘২০০৩ সালের মামলাও এখনো ঝুলে আছে। বিচারক দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টা করছেন, আমরাও সাক্ষ্যগ্রহণের ব্যবস্থা করছি।’
তবে বাস্তবতা বলছে, ১৮ থেকে ২০ বছরের পুরোনো মামলার সংখ্যা তিন শতাধিক।
রংপুর মহানগর নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব পলাশ কান্তি নাগ বলেন, ‘এই মামলাগুলোর বাদীরা এমনিতেই নির্যাতনের শিকার। তার ওপর বিচার না পেয়ে সহায় সম্বল বিক্রি করে আদালতে আসছেন। কিন্তু বিচার না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। এতে আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা তৈরি হচ্ছে।’
মানবাধিকারকর্মী ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহামুদুল হক বলেন, ‘যে দেশে নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়, সেই দেশে বছরের পর বছর ধরে বিচারহীনতায় ভুগছেন হাজারো ভুক্তভোগী। সংশ্লিষ্টদের উচিত জরুরি ভিত্তিতে চলমান মামলাগুলোর নিষ্পত্তি করা। কারণ প্রতিটি বিলম্বিত বিচার মানে একেকটি ভাঙা হৃদয়, একেকটি ন্যায়বিচারের অপমান।’
সম্প্রতি মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া আট বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় সারাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করে সরকার; যা তদন্তের সময় ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ দিন করা হয়। আর ধর্ষণের মামলায় ৯০ দিনের মধ্যে বিচার করার বিধান করা হয়। তবে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নয়।
মূলত ধর্ষণের মামলায় তদন্ত ও বিচার করার সময় কমিয়ে অর্ধেক করার উদ্যোগ নিতেই এ সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
রংপুর জেলা ও দায়রা জজের পাবলিক প্রসিকিউটর আফতাব উদ্দীন বলেন, “সরকার একটি আদেশ দিয়েছেন ‘ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রে তদন্তের সময় ১৫ দিন এবং ধর্ষণের মামলায় ৯০ দিনের মধ্যে বিচার করতে হবে।’ তবে, এখন এটি ডাইরেক্টরি অর্ডার, বাধ্যতামূলক নয়। এটা যদি বাধ্যতামূলক করা হতো তাহলে মামলার জট থাকতো না।”