চট্টগ্রাম ব্যুরো: কেউ স্কেটিং করে, কেউ চার্লি চ্যাপলিন, কেউ ভূত সেজে মূকাভিনয়— এমন নানা ব্যতিক্রমী কায়দায় শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে ভোটের আগে শেষ প্রচার চালিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনের প্রার্থীরা। শুধু ব্যতিক্রমী সাজসজ্জা নয়, কেউ কেউ আবার দলবেঁধে গান, কবিতা, নাটকের মধ্য দিয়ে প্রচারপত্র বিলি করেও ভোট চেয়েছেন।
মোট কথা, প্রচারণার শেষদিনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস চষে বেড়িয়েছেন চাকসু ও হল সংসদের প্রার্থীরা। অনেকের সঙ্গে ছিলেন তাদের সমর্থকরাও। শেষদিনে উৎসবমুখর ক্যাম্পাসে প্রচারণার ভিন্নমাত্রা উপভোগও করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
১৮ দিনের টানা প্রচারণা শেষে প্রার্থীদের আনুষ্ঠানিক ভোট চাওয়ার পালা শেষ হচ্ছে আজ সোমবার (১৩ অক্টোবর) রাত ১২টায়। একদিন বিরতির পর বুধবার (১৫ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত হবে চাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন।
প্রচারের শেষদিনে সোমবার সকাল থেকেই প্রার্থীরা কেউ দলবেঁধে, কেউ একা নেমে পড়েন ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচে। বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন থেকে পাহাড়ঘেরা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অনুষদ, ঝুপড়ি, ছাত্রাবাসসহ সবখানেই ছিল প্রার্থীদের সরব পদচারণা।
দুপুরের দিকে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে স্কেটিং করে নির্বাচনি প্রচার চালাচ্ছিলেন চাকসুর সহ-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী অন্তর মণ্ডল। স্কেটিং করেই প্রার্থীদের কাছে কাছে গিয়ে ভোট চাচ্ছেন তিনি। তার এই ‘স্কেটিংযাত্রা’ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভিন্ন আমেজ তৈরি করে।

চাকসু নির্বাচনে ব্যতিক্রমী কায়দার প্রচারে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা। ছবি: সারাবাংলা
ভিন্নধর্মী প্রচারণার বিষয়ে অন্তর মণ্ডল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি চাকসুতে সহ-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রকাশনা পদে নির্বাচন করছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অবস্থা খুব নাজুক। আমি সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য কাজ করতে চাই। আমি একজন নৃত্যশিল্পী, সেইসঙ্গে চলচ্চিত্র সংসদের একজন সদস্য। আমি এই পদে ভালোভাবে কাজ করতে পারব।’
গত দুইদিনের প্রচারে চার্লি চ্যাপলিন সেজে মূকাভিনয় করে শিক্ষার্থীদের নজর কেড়েছেন নাট্যকলা বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী উলফাতুর রহমান রাকিব। তিনিও চাকসুর সহ-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রকাশনা পদে নির্বাচন করছেন।
প্রখ্যাত ব্রিটিশ কৌতুক অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত পোশাকে সেজে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন একাডেমিক ভবন, ক্যাফেটেরিয়া ও ঝুপড়িগুলোতে শিক্ষার্থীদের সামনে মূকাভিনয় করেন। শিক্ষার্থীরাও এ সময় তাকে নিয়ে হাসি-আনন্দে মেতে ওঠেন। অনেকে মুঠোফোনে তার সঙ্গে নেন সেলফি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়েছে চার্লি চ্যাপলিন সেজে রাকিবের মূকাভিনয়।
বিশ্ববিদ্যালয়কে উন্মুক্ত সাহিত্য চর্চার জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে চান রাকিব। জানতে চাইলে রাকিব সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ। সেই হিসেবে আমি সহ-সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক পদে নির্বাচিত হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি উন্মুক্ত সাহিত্য চর্চার জায়গা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে দেশের সাহিত্য সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিতে চাই।’
এদিকে ক্যাম্পাসে প্যানেলভিত্তিক প্রচারও চলেছে সমানতালে। ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’, ছাত্রদলের স্বনামে প্যানেল এবং ছাত্র ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সমন্বয়ে গঠিত ‘দ্রোহ পর্ষদ’, অরাজনৈতিক বৈচিত্র্যের ঐক্য প্যানেল শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনা তৈরি করতে পেরেছে।

শুধু ব্যতিক্রমী সাজসজ্জা নয়, দলবেঁধেও প্রচারপত্র বিলি করেছেন কেউ কেউ। ছবি: সারাবাংলা
বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে দলবেঁধে প্রচার চালাচ্ছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ইব্রাহিম রনি। হাসিমুখে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন, দোয়া চেয়ে প্রচারপত্রও বিলি করছেন।
ইব্রাহিম রনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজ নির্বাচনি প্রচারের শেষদিন। শেষ দিনে আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দোয়া নিতে এসেছি। শিক্ষার্থীরা আমাদের ভালোভাবে গ্রহণ করছে। আমরা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছি।’
কিছুক্ষণ পর একই অনুষদে যান ছাত্রদল প্যানেলের জিএস প্রার্থী শাফায়াত হোসেন। শিক্ষার্থীদের আদাব-সালাম দিয়ে হাতে দেন লিফলেট। এরপর কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠতে দেখা যায় তাকে।
শাফায়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘শেষ দিনে আমরা বিভিন্ন অনুষদে প্রচার চালাচ্ছি। নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যথেষ্ঠ উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। আমরা চাই প্রশাসন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।’
কলা অনুষদ ও ঝুপড়িতে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন দ্রোহ পর্ষদের প্রার্থীরা। লিফলেটের পাশাপাশি মৌখিকভাবেও নিজেদের অঙ্গীকারের কথাগুলো তুলে ধরছেন তারা।

শুধু ব্যতিক্রমী সাজসজ্জা নয়, দলবেঁধেও প্রচারপত্র বিলি করেছেন কেউ কেউ। ছবি: সারাবাংলা
দ্রোহ পর্ষদের ভিপি প্রার্থী রিজু লক্ষ্মী অবরোধ বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে নির্বাচনি প্রচার চালিয়েছি। আজ যেহেতু প্রচারের শেষ দিন, তাই আমরা বিভিন্ন হলে গিয়েছি। এখন পর্যন্ত নির্বাচনি পরিবেশ আমাদের কাছে ভালোই মনে হচ্ছে। আশা করব প্রশাসন শেষপর্যন্ত নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকবে।’
ক্যাম্পাসে সশরীর প্রচার তো আছেই, অনলাইনেও সরব প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা। ফেসবুকে প্রচারের ছবি-ভিডিও, লিফলেট, ইশতেহার আপলোড করে ভোট চাচ্ছেন প্রায় সবাই। শর্টফিল্ম, ছোট্ট নাটিকা বানিয়েও অনলাইনে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন অনেক প্রার্থী।
সর্বশেষ ১৯৯০ সালে চাকসু নির্বাচন হয়েছিল। এর প্রায় ৩৫ বছর পর চাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এবার মোট ভোটার প্রায় ২৭ হাজার, যার মধ্যে ছাত্রী প্রায় সাড়ে ১১ হাজার। প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেলের সংখ্যা ১৩টি। চাকসু ও হল সংসদে চূড়ান্ত প্রার্থী আছেন ৯০৮ জন। এর মধ্যে চাকসুর ২৬টি পদের বিপরীতে ৪১৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। আর হল সংসদের ১৪টি পদের বিপরীতে লড়বেন ৪৯৩ জন।