রাজশাহী: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেট-এ ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন-২০২৫ ঘিরে সরগরম হয়ে উঠেছে পুরো ক্যাম্পাস। নির্বাচনের বাকি আর মাত্র দুইদিন। শেষ সময়ে এসে ইশতেহারে বড় বড় প্রতিশ্রুতি ও নানা ধরনের প্রচারের মাধ্যমে প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের মন জয়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতে, দীর্ঘদিনের স্থায়ী সমস্যাগুলোর বাস্তবসম্মত সমাধান ছাড়া এসব ইশতেহার কেবল কথার ফুলঝুরি হয়েই থাকবে।
রাকসুর আলোচিত প্যানেলগুলো অনেক আগেই নিজেদের ইশতেহার ঘোষণা করলেও ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ তাদের ইশতেহার ঘোষণা করেছে ১২ অক্টোবর। প্রার্থীরা ঘোষিত ইশতেহারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট, খাবার ও সূপেয় পানির সংকট, চিকিৎসা অবহেলা, অ্যাকাডেমিক জটিলতা, লাইব্রেরি ও ল্যাবের সীমাবদ্ধতা, ক্যাম্পাসে নিরাপত্তাহীনতা, পরিবহণ সমস্যা, গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের প্রসারের ওপর।
ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেলের ইশতেহারে এসেছে বৈচিত্র্যতা। ইশতেহারের শুরুতেই তারা ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. শামসুজ্জোহার শাহাদাৎ দিবসকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে ঘোষণার দাবি তুলেছেন। পাশাপাশি বিবাহিত শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা আবাসিক হল নির্মাণের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তারা।
প্যানেলটির ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন আবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের মতামত নিয়ে আমরা ইশতেহারগুলো সাজিয়েছি। আমরা যে ইশতেহারগুলো দিয়েছি তার কোনোটাই অসম্ভব নয়। শিক্ষার্থীরা যদি আমাদের সঙ্গে থাকেন এবং প্রশাসনের সঙ্গে যদি আমরা সমন্বয় করতে পারি, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যেই এইগুলো আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব।’
রাকসু নির্বাচনে প্যানেলগুলোর ইশতেহারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে শিবির সমর্থিত প্যানেল ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’। ইশতেহারে ১২ মাসে ২৪টি সংস্কারের কথা জানিয়েছে প্যানেলটি। ইশতেহারে সাতটি বিষয়ে ‘হ্যাঁ’ এবং সাতটি বিষয়ে ‘না’ বলেছে প্যানেলটি। প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ সারাাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মনে করি ১২ মাসে এই ২৪টি সংস্কার সম্ভব। এগুলো শেষ করেও আরও কিছু কাজ করা সম্ভব বলেও আমরা আশা করছি। এক বছরের মধ্যেই যেন সব কাজ শেষ করা যায়, সেভাবেই আমরা আমাদের ইশতেহার সাজিয়েছি।’
‘সার্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলটি অনেক আগেই ১২ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছিলেন। তারা তাদের ইশতেহারে উপাচার্য নির্বাচন চালুর দাবিও জানিয়েছেন। এ বিষয়ে ভিপি পদপ্রার্থী তাসিন খান সারাাবংলাকে বলেন, ‘রাকসুর একজন ভিপি, জিএস অথবা অন্যান্য পদগুলোর ক্ষমতাকে মাথায় রেখেই আমরা ১২টি বাস্তবসম্মত ইশতেহার নিয়ে নির্বাচনে নিয়েছি। যদি নির্বাচিত হই তাহলে এক বছরেই এইগুলো বাস্তবায়ন করব।’
বাম সমর্থিত ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’ প্যানেল তাদের ইশতেহারে রাকসুর কাঠামো সংস্কার ও ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষার্থীদের ক্ষমতায়নের কথা বলেছেন। প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ফুয়াদ রাতুল সারাাবাংলাকে বলেন, ‘রাকসুকে আমরা গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস বিনির্মাণের একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখি। জুলাই আন্দোলনেও আমরা ছাত্রলীগের সন্ত্রাস ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলাম। রাকসুর প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হতে পারলে শিক্ষার্থীদের আবাসন, খাদ্যসংকটসহ শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো নিরসনে কাজ করব।’
অন্যদিকে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছে, প্রার্থীদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো নতুন কিছু নয়। তাদের মতে, এই প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে এবং বাস্তবায়ন হবে তা দেখার বিষয়। অনেক শিক্ষার্থী আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, কিছু প্রার্থী গঠনতন্ত্রের সীমানা অতিক্রম করে এমন ইশতেহার দিচ্ছে, যা বাস্তবতার সঙ্গে মিল রাখে না এবং শুধুই ভোটপ্রলোভনের জন্য দেওয়া হচ্ছে।
ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী রাফায়েল মারুফ সারাবাংলার এই প্রতিবেদকে বলেন, ‘আমার মনে হয় প্রার্থীদের দেওয়া অনেক প্রতিশ্রুতি নতুন নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এগুলো কতটা কার্যকর হবে তা দেখা। কিছু প্রার্থী সীমার বাইরে গিয়ে বড় বড় প্রতিশ্রুতি দেয়, যা বাস্তবায়ন অসম্ভব। তাই আমাদের উচিত সতর্কভাবে দেখে ভোট দেওয়া। যারা সত্যিই শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে কাজ করতে পারবেন তাদেরকে সমর্থন করা।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী হাসিবুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী রাকসু একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। ফলে এটার ক্ষমতাও সীমিত। তবে যেহেতু সকল শিক্ষার্থীর ম্যান্ডেট নিয়ে রাকসু আসছে, তাই অনেকক্ষেত্রে এটা প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করতে পারবে। রাকসুর ইশতেহারগুলা অনেকক্ষেত্রেই অবাস্তব। ফলে রাকসুর পরে তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবে বলে মনে হয় না। সেশনজট যেকোনো সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি। রাকসু চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে বলে আমি মনে করি।’
উল্লেখ্য, দীর্ঘ ৩৫ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে রাকসু নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে মোট ৯০৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে রাকসুতে ২৪৮ জন, সিনেটের ছাত্র প্রতিনিধি পদে ৫৮ জন এবং ১৭টি আবাসিক হল সংসদে ৫৯৭ জন প্রার্থী লড়ছেন। আগামী ১৬ অক্টোবর একযোগে অনুষ্ঠিত হবে রাকসু, হল সংসদ ও সিনেট-এ ছাত্রপ্রতিনিধি নির্বাচনের ভোট। এরপর সেদিনই গণনা শেষে ফলাফল ঘোষণা করা হবে।