বগুড়া: বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকার এক ভুল অপারেশনের শিকার হয়ে বিচারের ও ক্ষতিপূরণের আশায় ঘুরছেন প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে। শুধু তাই নয় বিচার চাওয়ার কারণে হারিয়েছেন তার স্কুলের চাকরি। সামনের দিনগুলো কিভাবে কাটবে সেই চিন্তা করতে করতে নিজের জীবনের সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে তার। মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) দুপুরে বগুড়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকদের কাছে এমন তথ্য জানান তিনি।
শিক্ষিকা মোছা: শিমু আক্তার বলেন, গত বছর মার্চ মাসের প্রথম দিকে পেট ব্যথা ও বমির সমস্যা নিয়ে তার পরিচিত শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ডাঃ ফাহমিদা হরকিলের (গাইনি রোগ বিশেষজ্ঞ) সঙ্গে দেখা করি। তখন তিনি আমাকে ডাঃ এ.বি.এম জাফর সাদিকের সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দেন। এরপর আমি গত বছরের ১৬ মার্চ বগুড়া পপুলার ক্লিনিকে ডাক্তার এ.বি.এম জাফর সাদিকের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে প্রাথমিকভাবে পরিক্ষা করে WHOLE ABDOMEN OF CT SCAN করার পরামর্শ দেন।
আমি গত বছরের ২১ মার্চ বগুড়া ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরিক্ষাটি ডাঃ মো. নাসির উদ্দিনের কাছে ওই টেস্ট করাই। এরপর রিপোর্ট নিয়ে সেদিনই ডাক্তার এ, বি, এম জাফর সাদিকের সঙ্গে দেখা করি। রিপোর্ট দেখে তিনি জানান Appendictis ধরা পরেছে এবং Thickened Cervix DDX: Chronic Ceicitis সমস্যা রয়েছে যার কারণে পেটে ব্যথা হচ্ছে। আমি তাকে জানাই ২০০৩ সালেই আমার এ্যাপেনডিস্ক অপারেশন করা হয়েছে। তখন তিনি বলেন যে, আমি ল্যাপারোস্কপির মাধ্যমে দেখব যে, আপনার এ্যাপেনডিস্ক এর সমস্যা আছে কিনা যেহেতু রিপোর্টে এ্যাপেনডিস্ক এভিডেন্স পাওয়া গেছে।
রিপোর্টটি নিয়ে বগুড়া গ্রীন লাইফ ক্লিনিকে ডা: ফাহমিদা হরকিলকে বিষয়টা জানালে তিনি বলেন যে, আমার ক্লিনিকে ডা: আব্দুল হালিমকে দিয়ে আপনার অপারেশন করিয়ে দেব। পরবর্তীতে আমি মোহাম্মাদ আলী হাসপাতালের ডা: আব্দুল হালিমের সঙ্গে কাগজপত্র নিয়ে দেখা করলে তিনি রিপোর্ট দেখে জরুরীভিত্তিতে আমার অপারেশন করাতে হবে বলে জানান। ২৬ মার্চ তিনি আমার অপারেশন করেন।
অপারেশন থিয়েটারে আমাকে রিজিওনাল এ্যানস্থেশিয়া (স্পাইনাল) দেওয়ায় আমার কোমর থেকে পা পর্যন্ত অনুভূতিহীন ছিল কিন্তু আমার হুঁশ অবস্থায় থাকায় আমি ডাক্তারের সব কথা শুনতে পাই। অপারেশন করে তিনি বলেন যে, রিপোর্ট সম্পূর্ণ ভুল। রিপোর্ট অনুযায়ী অপারেশন করে কিছুই পাওয়া যাইনি। তখন থেকে আমি মানসিক ও শারিরিকভাবে ভেঙ্গে পরি।
এরপর শহরের ইবনে সিনা হাসপাতালের ম্যানেজার ফরহাদ সাহেবকে বিষয়টা জানাই। তখন তিনি বিষয়টা কাউকে না জানানোর জন্য আমাকে অনুরোধ করেন এবং তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, আমরা আপনাকে দেখতে আসছি। আপনার উন্নত চিকিৎসার জন্য এবং এই ভুল অপারেশনের জন্য যে ক্ষতি আপনার হয়েছে তার জন্য আমরা সার্বিকভাবে আপনাকে সহযোগিতা করবো।
আমি ৭ দিন ক্লিনিকে ছিলাম কিন্তু তারা আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। দীর্ঘ ৭ দিন ক্লিনিকে থাকার পর আমি বাসায় আসি এবং ফোনে ও স্বশরীরে তাদের সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু তারা আমরা বিষয়টা এড়িয়ে যেতে থাকেন ।
কয়েকদিন অপেক্ষা করার পর ইবনে সিনায় গেলে জানতে পারি যে, ম্যানেজার ফরহাদ সাহেব বদলি হয়ে গেছেন এবং তার স্থানে যোগ দেওয়া নতুন ম্যানেজারে মো. আশাফুল ইসলামে সঙ্গে আমার বিষয়টি নিয়ে কথা বলি। তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বাস দেন এবং দুই দিন পর দেখা করতে বলেন।
এক পর্যায়ে ইবনে সিনায় কর্মরত রেজা নামের একজন কর্মকর্তা জানান, আমরা রিপোর্ট তৈরি করা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছেন যে সেখানে একটা প্রিন্টিং মিসটেক হয়েছে। তখন আমি তাদের জিজ্ঞেস করি, আপনাদের এই প্রিন্ট মিসটেকের জন্য আমার তলপেটে নাভি থেকে নিচ বরাবর প্রায় ৭ ইঞ্চি পরিামণ অনাকাঙ্খিত অপারেশন হয়েছে। এই ভুলের দায়ভার কে নেবে?’
শিমু আক্তার আরো জানান, ‘পরবর্তীতে আমি বগুড়া জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জন বরাবর লিখিত অভিযোগ করলে দীর্ঘ দিন তদন্ত শেষে চলতি বছরের ৪ মার্চ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের চিঠির মাধ্যমে আমাকে জানানো হয় যে, আমার অভিযোগটি প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়নি। বিষয়টি জানার পরে আমি ডাঃ আব্দুল হালিমকে ফোন করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিভিল সার্জন অফিসে তাকে ডেকে নিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা: ফারজানুল ইসলাম (উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বগুড়া সদর)-সহ সবাই মিলে যা লিখতে বলেছে আমি তাই লিখেছি।
এই বিষয়টিও জেলা প্রশাসকে বিষয়টি জানাই। এরপর দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হলেও কোনো তদন্ত না হওয়ায় আমি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট বরাবর অভিযোগ জানাই। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর বগুড়া জেলা প্রশাসকের কাছে পুনঃতদন্তের জন্য যে আবেদন করেছিলাম তা ২১ সেপ্টেম্বর তদন্ত হয়। সেখানে আমার কোনো অভিযোগই তারা আমলে নেননি ।
সেইসঙ্গে বগুড়া ইউনিক পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এই চাকরি করে আমি আমার জীবিকা নির্বাহ করতাম। বর্তমানে আমি মানসিক ও শারিরীকভাবে খুবই অসুস্থ। বর্তমানে প্রাইভেট পড়িয়ে আমি কোনো রকম আমার চিকিৎসা ও জীবনযাপন করছি। এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আমি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্মানিত মহাপরিচালকের কাছে দাবি জানাই যে, আমার সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে তা যেন আর কারো সঙ্গে না ঘটে এবং এ বিষয়ে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন যথাযথ ব্যবস্থা করে।’