চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীদের মুখোমুখি অবস্থানের মধ্যে মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) মধ্যরাত থেকে বন্দরের বিভিন্ন সেবা খাতে নতুন মাশুল (ট্যারিফ) কার্যকর হতে যাচ্ছে, যা বেড়েছে প্রায় ৪১ শতাংশ হারে।
ব্যবসায়ীরা লাভজনক প্রতিষ্ঠান বন্দর কর্তৃপক্ষ কাদের স্বার্থে মাশুল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ প্রশ্ন তুলেছেন। রাজনৈতিক দল ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর অভিযোগ, বন্দরের বিভিন্ন কনটেইনার টার্মিনাল ইজারা দিতে যাওয়া বিদেশি কোম্পানিগুলোকে সুবিধা দিতেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের এখতিয়ার বর্হিভূত এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ অবস্থায় মাশুল বাড়ানোর কারণে আমদানি-রফতানির খরচ বহুগুণে বাড়বে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি দিয়েছেন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী। তিনি ‘পোর্ট ইউজার্স ফোরামের’ আহ্বায়কের দায়িত্বে আছেন। তবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, সরকারিভাবে গেজেট হয়ে যাবার পর বর্ধিত হারে মাশুল আদায়ের বিকল্প নেই।
চট্টগ্রাম বন্দরে মোট ৫২টি খাতে মাশুল আদায় করা হয়। সেখান থেকে ২৩টি খাতে মাশুল বাড়ানো হয়েছে। মাশুল বাড়ানোর এ আলোচনা শুরু হয়েছিল ২০২২ সাল থেকে। তবে তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার এ বিষয়ে ‘ধীরে চলো’ নীতি অবলম্বন করেছিল বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্পেনের প্রতিষ্ঠান ‘আইডম’ এশিয়ার ১০টিসহ বিশ্বের ১৭টি আন্তর্জাতিক বন্দরের কার্যক্রম এবং মাশুল পর্যালোচনা করে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রস্তাবিত নতুন মাশুল হার নির্ধারণ করে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চলতি বছরের জুনে মাশুল বাড়ানোর প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।
প্রস্তাবিত মাশুল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর গত ২৪ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয় অনুমোদন করে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে গেজেট আকারে প্রকাশের পর কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের আগে বন্দর ব্যবহারকারীদের নিয়ে গত ২৫ আগস্ট নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে একটি সভা হয়। এতে ব্যবসায়ীরা নতুন মাশুল নিয়ে তীব্র আপত্তি তোলেন।
ব্যবসায়ীদের আপত্তির পরও সরকার গত ১৪ সেপ্টেম্বর নতুন মাশুলের গেজেট প্রকাশ করে, যা ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়। সরকারি প্রজ্ঞাপনমতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২৩টি খাতে বর্ধিত হারে মাশুল আদায় কার্যকর করায় বন্দর ব্যবহারের ওপর খরচ বেড়ে যায় সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশ পর্যন্ত।
এরপর গত ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে এক কর্মশালায় নৌপরিবহন উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেনের উপস্থিতিতে বন্দর ব্যবহারকারীরা এ বিষয়ে আপত্তি তুলে ধরেন। আপত্তির মুখে উপদেষ্টা বর্ধিত ট্যারিফ (মাশুল) আদায় এক মাস পেছানোর সিদ্ধান্ত জানান।
স্থগিতের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে অর্থাৎ ১৫ অক্টোবর থেকে বর্ধিত হারে মাশুল আদায় করার ঘোষণা দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। গত ৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থ ও হিসাবরক্ষণ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা মো. আবদুস শাকুরের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এরপর আবারও ব্যবসায়ীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বর্ধিত মাশুলের প্রতিবাদে চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক ও সীকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হকের উদ্যোগে ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে এক প্রতিবাদ সভা হয়। সেই সভায় চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী অন্তর্বর্তী সরকারের মাশুল বাড়ানোর এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে সমঝোতায় না পৌঁছা পর্যন্ত স্থগিত রাখার দাবি জানান।
সভায় মোহাম্মদ আমীরুল হক বলেন, ’৪১ শতাংশ হারে ট্যারিফ বাড়িয়ে দেওয়া হল। হঠাৎ এটা কেন? মোংলা বন্দরে তো বাড়েনি, পায়রায় তো বাড়েনি, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দরে কেন? এই ট্যারিফ বাড়ানো একটা ষড়যন্ত্র। আমাদের বন্দরকে ষড়যন্ত্রের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে স্বাধীন পরিচালক আছে, তাহলে বন্দরে নেই কেন? যারা বন্দর ব্যবহার করে তাদের কথা শুনবে না, ট্যারিফ বাড়াবে অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের কেন ট্যারিফ বাড়াতে হবে? এটা তাদের কাজ?’
‘আমি ৪০ বছর ধরে ব্যবসা করছি, কচি খোকা নয়। আমরা ব্যবসায়ী, আমরা বন্দর ব্যবহার করি, আমরা কারও গোলাম নই। আমার টাকায় বন্দর চলবে আর আমার কথা না শুনে ট্যারিফ বাড়িয়ে দেবে, আমরা কি কলুর বলদ? এই যে ট্যারিফ বাড়াল, এটার পেমেন্ট তো ব্যবসায়ীরা করবে না, জনগণকে করতে হবে। বন্দরকে কস্ট বেইজড ট্যারিফ করতে হবে।‘
পণ্য আমদানি ও রফতানি মিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সর্বোচ্চ ব্যবহারকারী হলেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা। তাদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সেলিম রহমান ওই সভায় বলেন, ‘তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি দুটোই করে। ভিয়েতনাম, ভারত, মালয়েশিয়ার চেয়ে আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরে ব্যয় বেশি। তারপর আবারও ট্যারিফ বাড়ানো হচ্ছে। সবচেয়ে বড় আঘাতটা আসবে পোশাক শিল্পের ওপর। ২৯ বছরের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতায় চট্টগ্রাম বন্দরকে কখনো লস করতে দেখিনি। তাহলে বন্দরে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ কেন বাড়াতে হবে?’
এরপর মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী প্রধান উপেদষ্টা বরাবরে একটি চিঠি পাঠান। চিঠিতে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ চেয়ে তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত নতুন ট্যারিফ বাস্তবায়ন আপাতত স্থগিত রাখা হোক এবং বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য একটি সময়োপযোগী পর্যালোচনার উদ্যোগ নেওয়া হোক। সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারের (স্থানীয় শিপিং এজেন্ট, আমদানি-রফতানিকারক, জাহাজ মালিক, ব্যবসায়ী সংগঠন) সঙ্গে পরামর্শক্রমে যৌক্তিক ও বাস্তবভিত্তিক ট্যারিফ কাঠামো নির্ধারণ করা হোক। বন্দরের কাঠামোগত উন্নয়ন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে সেবা-ভিত্তিক এবং অলাভজনক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখা হোক।’
‘চট্টগ্রাম বন্দর কেবল একটি বন্দর নয়-এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। এই বন্দর ঘিরেই গড়ে উঠেছে দেশের বৃহৎ রফতানি-আমদানি কার্যক্রম, শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়। তাই এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেকোনো নীতিগত পরিবর্তন অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং জাতীয় অর্থনীতির ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে সক্ষম।’
নতুন মাশুল হার অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরে আসা-যাওয়া করা সব জাহাজে এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সব ক্ষেত্রেই মাশুল বেড়েছে। আগে যেখানে একটি জাহাজের পাইলটিং চার্জ ছিল ৩৫৭ দশমিক ৫০ ডলার, এখন সেখানে করা হয়েছে ৮০০ ডলার। আগে যেখানে ২০০ থেকে ১০০০ জিআরটির জাহাজের টাগ চার্জ ছিল ১৫৮ ডলার, এখন তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬১৫ ডলার। ইকুইপমেন্টের ক্ষেত্রে আগে যেখানে পণ্যভর্তি ২০ ফুট কনটেইনারের কী-গ্যান্ট্রিক্রেন চার্জ ছিল ১৫ ডলার, এখন তা ২০ দশমিক ৮০ ডলার করা হয়েছে। ২০ ফুটের খালি কনটেইনারের ক্ষেত্রে ৭ দশমিক ৫০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৪০ ডলার করা হয়েছে। ১০ টনের মোবাইল ক্রেন ব্যবহারে আগে দিতে হতো ১ দশমিক ৭২৩ ডলার, এখন দিতে হবে ১০ দশমিক ৭০ ডলার।
আমদানি করা এফসিএল কনটেইনারের ক্ষেত্রে প্রথম চার দিন, রফতানিযোগ্য এফসিএল এবং এলসিএল কনটেইনারে ছয় দিন ফ্রি টাইম রাখা হয়েছে। কিন্তু সপ্তম দিন থেকে ৬ দশমিক ৯ শূন্য ডলার দিয়ে শুরু হবে মাশুল আদায়। আর ২১ দিন পার হলেই যুক্ত হবে ৬২ মার্কিন ডলার করে। এ ছাড়া এখন থেকে বন্দরে জাহাজের অবস্থানকালীন সময় ১২ ঘণ্টা অতিরিক্ত অবস্থানের জন্য ১০০ শতাংশ, ২৪ ঘণ্টার জন্য ৩০০, ৩৬ ঘণ্টার জন্য ৪০০ এবং ৩৬ ঘণ্টার বেশি হলে অতিরিক্ত চার্জ ৯০০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে প্রতিটি কনটেইনারে বর্তমানে গড়ে মাশুল আদায় হয় ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা। এখন তা বেড়ে হবে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা। অর্থাৎ কনটেইনারপ্রতি মাশুল বাড়ছে গড়ে ৩৭ শতাংশ। প্রতিটি কনটেইনার জাহাজ থেকে ওঠানো বা নামানোর জন্য পরিশোধ করতে হতো ৪৩ দশমিক ৪০ ডলার। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৬৮ ডলার। বাল্কের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি পণ্যে আগে গড়ে মাশুল দিতে হতো ১ টাকা ২৮ পয়সা, এখন আরও বাড়তি দিতে হবে ৪৭ পয়সা।
বর্ধিত মাশুল প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৯৮৬ সালে প্রতি ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকা ছিল ৩০ টাকা। এখন সেটা বেড়ে ১২২ টাকা হয়েছে। এ হিসেবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ট্যারিফ তো বাড়ছেই। নতুন করে আবার বাড়াতে হবে কেন? বর্ধিত মাশুল দিতে গেলে প্রতি কনটেইনারে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা বাড়তি খরচ হবে। আর এই টাকা গিয়ে পড়বে ভোক্তাদের ওপর।’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ট্যারিফ বাড়ানোর বিষয়টি সরকারি বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সরকারিভাবে গেজেট হয়েছে। এখন আমাদের তো এর বাইরে যাবার সুযোগ নেই। নৌপরিবহন উপদেষ্টা মহোদয় একমাস স্থগিত করেছেন। গেজেট তো বাতিল হয়নি। একমাস স্থগিতের পর এখন আমাদের সেটা কার্যকর করা বাধ্যতামূলক। আর ব্যবসায়ীরা যেভাবে ট্যারিফ বাড়ানোর প্রভাব ভোক্তাদের ওপর পড়বে বলছেন, বিষয়টি সেরকম নয়। আমরা হিসেব করেছি, প্রতি কেজিতে মাত্র ১২ পয়সা করে খরচ বাড়বে। এতে ভোক্তাপর্যায়ে কোনো প্রভাব পড়বে না।’