চট্টগ্রাম ব্যুরো: প্রায় সাড়ে তিন দশক পর আজ (বুধবার) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পাহাড়ঘেরা সবুজ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা মেতে উঠেছেন ভোট উৎসবে। প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষার্থী ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন।
বুধবার (১৫ অক্টোবর) সকাল ৯টা থেকে চাকসু ও হল সংসদের ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। চলবে একটানা বিকেল ৪টা পর্যন্ত। এরপর গণনা শেষে ভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হবে।
চাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুন্দরভাবে ভোটগ্রহণের সব প্রস্তুতি আমাদের আছে। ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার আছে। শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে ভোট দিয়ে ফিরে যেতে পারবেন। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটগ্রহণ থেকে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত সকল কার্যক্রম সুন্দরভাবে সম্পন্ন হবে বলে আমরা আশাবাদী।’

কেন্দ্রের বাইরে শিক্ষার্থীরা। ছবি: সারাবাংলা
ক্যাম্পাস থেকে সারাবাংলা’র চবি করেসপন্ডেন্ট মোস্তাফিজুর রহমান রাফি জানিয়েছেন, ভোরের আলো ফুটতেই সরগরম হয়ে উঠেছে চবি ক্যাম্পাস। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাজারো সদস্যের সতর্ক অবস্থান আছে ক্যাম্পাসজুড়ে। ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই ভোটগ্রহণ শুরুর আগেই ক্যাম্পাসে এসেছেন।
এছাড়া সকালে কেন্দ্রে-কেন্দ্রে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ব্যালট পেপার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
চাকসু ও হল সংসদের নির্বাচনে এবার মোট ভোটার বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ হাজার ৫২১ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছাত্র ভোটার ১৬ হাজার ৮৪ জন ও ছাত্রী ভোটার ১১ হাজার ৩২৯ জন। তাদের ভোটে এক বছরের জন্য গঠিত হবে ২৬ সদস্যের কেন্দ্রীয় সংসদ। একই মেয়াদে ১৪টি হল ও একটি হোস্টেলেও গঠিত হচ্ছে সংসদ। আর চাকসু মনোনীত পাঁচ শিক্ষার্থী প্রতিনিধি হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম—সিনেটের সদস্য।

ভোটকেন্দ্রের বাইরে শিক্ষার্থীদের লাইন। ছবি: সারাবাংলা
নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্যমতে, কেন্দ্রীয় সংসদের ২৬ পদের জন্য মোট প্রার্থী ৪১৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ প্রার্থী ৩৬৮ জন এবং নারী প্রার্থী ৪৭ জন। এতে সহ-সভাপতি পদে ২৪ জন, সাধারণ সম্পাদক পদে ২২ জন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে ২১ জন, খেলাধুলা ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে ১২ জন, সহ খেলাধুলা ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে ১৪ জন, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে ১৭ জন, সহ সাহিত্য সংস্কৃতি ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে ১৫ জন, দফতর সম্পাদক পদে ১৭ জন, সহ দফতর সম্পাদক পদে ১৪ জন, ছাত্রী কল্যাণ সম্পাদক পদে ১৩ জন, সহ ছাত্রী কল্যাণ সম্পাদক পদে ১০ জন, বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি সম্পাদক পদে ১১ জন, গবেষণা ও উদ্ভাবন সম্পাদক পদে ১২ জন, সমাজসেবা ও পরিবেশ সম্পাদক পদে ২০ জন, স্বাস্থ্য সম্পাদক পদে ১৫ জন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে ১৭ জন, ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট ও আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে ১৬ জন, যোগাযোগ ও আবাসন সম্পাদক পদে ১৭ জন, সহ যোগাযোগ ও আবাসন সম্পাদক পদে ১৪ জন, আইন ও মানবাধিকার সম্পাদক পদে ৯ জন, পাঠাগার ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ২০ জন এবং পাঁচটি নির্বাহী সদস্য পদের বিপরীতে প্রার্থী হয়েছেন ৮৫ জন।
এছাড়া ১৪টি হল সংসদ ও ১টি হোস্টেল সংসদের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে মোট পদ ২০৬টি। প্রতি হলে পদ ১৪টি। আর হোস্টেলে পদ ১০টি। মোট প্রার্থী জন। এর মধ্যে ৯ ছাত্র হলের প্রার্থী ৩৫০ জন ও ৫ ছাত্রী হলের প্রার্থী ১২৩ জন।
ছাত্র হলগুলোর মধ্যে এ এফ রহমান হলে প্রার্থী ৩৮ জন, আলাওল হলে ৩২ জন, অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান হলে ৩৭ জন, শাহ আমানত হলে ৪৩ জন, শহীদ আবদুর রব হলে ৩১ জন, শহীদ ফরহাদ হোসেন হলে ৪৫ জন, শাহজালাল হলে ৩৪ জন, সোহরাওয়ার্দী হলে ৫৩ জন, মাস্টারদা সূর্যসেন হলে ৩৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

ভোট দিতে আসা শিক্ষার্থীরা। ছবি: সারাবাংলা
ছাত্রী হলের মধ্যে বিজয় ২৪ হলে ২৮ জন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হলে ৩০ জন, নবাব ফয়জুন্নেসা হলে ১৭ জন, প্রীতিলতা হলে ২৬ জন, শামসুন্নাহার হলে ২২ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আর শিল্পী রশিদ চৌধুরী হোস্টেলে বিভিন্ন পদে লড়ছেন ২০ জন প্রার্থী।
চাকসু নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে মোট ১৩টি প্যানেল। প্যানেলগুলো থেকে ভিপি-জিএস-এজিএস পদে অংশ নিচ্ছেন মোট ৬৯ জন প্রার্থী। এদের মধ্যে ছাত্রদল থেকে সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়, শাফায়াত ও আইয়ুবুর রহমান তৌফিক, ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল থেকে ইব্রাহিম হোসেন রনি, সাঈদ বিন হাবিব ও সাজ্জাদ হোসাইন মুন্না, ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্রফ্রন্টের ‘দ্রোহ পর্ষদ’ থেকে ঋজু লক্ষ্মী অবরোধ, ইফাজ উদ্দিন আহমেদ ও জোনায়েদ কবির শায়র এবং বামধারার বৈচিত্র্যের ঐক্য প্যানেল থেকে ধ্রুব বড়ুয়া, সুদর্শন চাকমা ও জশদ জাকির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন।
অন্যান্যের মধ্যে ছাত্র ফেডারেশন সমর্থিত ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল থেকে আবির বিন জাবেদ, চৌধুরী তাসনিম জাহান শ্রাবণ ও পলাশ দে, বৈষম্যবিরোধী সাবেক সমন্বয়কদের প্যানেল ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ থেকে মাহফুজুর রহমান, রশিদ দিনার ও জান্নাতুল ফেরদৌস, ছাত্র অধিকার পরিষদ ও ইসলামী ছাত্র মজলিসের ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ থেকে তামজিদ উদ্দিন, সাকিব মাহমুদ রুমি ও রোমান রহমান, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের ‘সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ’ থেকে আব্দুর রহমান রবিন, মোহাম্মদ আব্দুর রহমান ও আমিনুল ইসলাম রাকিব, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী ঐক্য পরিষদ’ থেকে সাইদ মো. রেদওয়ান, জিহাদ আরাফাত ও আবদুল্লাহ আল মামুন, অরাজনৈতিক ‘সার্বভৌম শিক্ষার্থী ঐক্য’ থেকে তাওসিফ মুত্তাকি চৌধুরী, মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসাইন ও সাঈদ মোহাম্মদ মুশফিক হাসান, সুফিপন্থী ‘অহিংস শিক্ষার্থী ঐক্য’ থেকে ফরহাদুল ইসলাম, ইয়াসিন উদ্দিন সাকিব ও শহীদুল ইসলাম শাহেদ, বিশ্ব ইনসানিয়াত বিপ্লবী স্টুডেন্ট ফ্রন্টের ‘রেভ্যুলেশন ফর স্টেট অব হিউম্যানিটি’ থেকে কেফায়েত উল্লাহ, শাহরিয়ার উল্লাহ ও জোনায়েদ শিবলী যথাক্রমে ভিপি-জিএস-এজিএস পদে প্রার্থী হয়েছেন।
এছাড়া ‘ভয়েস অব সিইউ’ নামে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থীদের একটি প্যানেল থেকে দফতর সম্পাদক, যোগাযোগ ও আবাসন সম্পাদক এবং মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে।
পাঁচটি অনুষদ ভবন যথাক্রমে কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, বিজ্ঞান অনুষদ ও প্রকৌশল অনুষদ ভবনে ভোটগ্রহণ চলছে। এসব অনুষদের ৬০টি কক্ষে প্রায় ৭০০ বুথে ভোটগ্রহণ হচ্ছে। এর মধ্যে আইটি ভবনে সোহরাওয়াদী হলের শিক্ষার্থীরা, নতুন কলা ভবনে শাহজালাল, এফ রহমান ও আলাওল হলের শিক্ষার্থীরা, বিজ্ঞান অনুষদ ভবনে শাহ আমানত ও মাস্টার দা সূর্য সেন হল, সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ ভবনে নওয়াব ফয়েজুন্নেসা, শামসুন নাহার, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও অতীশ দীপঙ্কর হলের শিক্ষার্থীরা এবং বাণিজ্য অনুষদ (বিবিএ) ভবনে প্রীতিলতা, বিজয় ২৪, শহিদ ফরহাদ হোসেন হল ও শিল্পী রশিদ চৌধুরী হোস্টেলের শিক্ষার্থীরা ভোট দিচ্ছেন।

ভোটদানের পরিবেশ নির্বিঘ্ন রাখতে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ছবি: সারাবাংলা
এছাড়া চাকসু ভবনের দ্বিতীয় তলায় দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা ভোট কেন্দ্র করা হয়েছে। এ কেন্দ্রে শুধু দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীরা দুই নির্বাচন কমিশনারের তত্বাবধানের তাদের পছন্দের প্রতিনিধি মনোনয়নে ভোট দেবেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ মোট ১৫ জন শিক্ষক-কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচন কমিশন ভোট পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ওএমআর ব্যালট শিটে শিক্ষার্থীরা ভোট দেবেন। চাকসুতে থাকছে চার পৃষ্ঠার এবং হল ও হোস্টেল সংসদের থাকছে এক পৃষ্ঠার ব্যালট।
নির্বাচন কমিশন প্রকাশিত ‘ভোটারদের জন্য নির্দেশিকা’তে বলা হয়েছে, নির্বাচনের দিন ভোটারদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড সঙ্গে রাখতে হবে। ভোটাররা কেবল নির্ধারিত হলে ভোট দিতে পারবেন। প্রতিটি ভোটকক্ষে সর্বোচ্চ ৫০০ শিক্ষার্থী ভোট দেবেন। ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের পর পরিচয় যাচাই শেষে শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ পাঁচটি ব্যালট পেপার দেওয়া হবে—এর মধ্যে চারটি কেন্দ্রীয় সংসদ (চাকসু) এবং একটি নিজ হল সংসদের জন্য।
ব্যালটে নির্ধারিত প্রতীকের পাশে বৃত্ত ভরাট করতে হবে ভোটারদের। ব্যালট নির্দিষ্ট বাক্সে ফেলার পর ভোটারকে কেন্দ্র ত্যাগ করতে হবে। কেন্দ্রের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষায় প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অ্যাসিস্ট্যান্ট, রোভার স্কাউট ও নিরাপত্তা কর্মীরা দায়িত্ব পালন করবেন। ভোট গণনা করা হবে ওএমআরে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি সপ্তম ছাত্র সংসদ নির্বাচন। ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭০ সালে প্রথম ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন ছাত্রলীগের মোহাম্মদ ইব্রাহিম এবং জিএস হন ছাত্রলীগের আবদুর রব। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়াতে তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন চাকসু জিএস আবদুর রব।
১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় চাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের শামসুজ্জামান হীরা ভিপি এবং জাসদ ছাত্রলীগের মাহমুদুর রহমান মান্না জিএস নির্বাচিত হন।
১৯৭৪ সালের তৃতীয় চাকসু নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলীগের এস এম ফজলুল হক ভিপি ও গোলাম জিলানী চৌধুরী জিএস নির্বাচিত হন।
১৯৭৯ সালের চতুর্থ চাকসু নির্বাচনে ভিপি হন জাসদ ছাত্রলীগের মাজহারুল হক শাহ চৌধুরী এবং জিএস হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের জমির চৌধুরী।
১৯৮১ সালে চাকসুর পঞ্চম নির্বাচনে ভিপি ও জিএস পদে নির্বাচিত হন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেসময়ের নেতা জসিম উদ্দিন সরকার ও আবদুল গাফফার।
১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ চাকসু নির্বাচনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্রার্থী জাতীয় ছাত্রলীগের নাজিম উদ্দিন ভিপি নির্বাচিত হন। আর জিএস নির্বাচিত হন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি আজিম উদ্দিন আহমদ।
কিন্তু সর্বশেষ ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতা ফারুকুজ্জামান নিহত হলে চাকসুর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর গত ৩৫ বছরে আর চাকসু নির্বাচন হয়নি।