Saturday 18 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৩৪ দল চায় ২০০ আসন
শরিকদের চাহিদায় বেকায়দায় বিএনপি!

মো. মহসিন হোসেন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৮ অক্টোবর ২০২৫ ২২:২৭

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি। ফাইল ছবি

ঢাকা: আসছে বছরের ফেব্রুয়ারি প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই অনুযায়ী নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে। সবমিলিয়ে দেশে বইছে নির্বাচনি হাওয়া। তবে নির্বাচনের মৌসুম এলেই রাজনৈতিক দলগুলোর জোটরাজনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এমনই ধারাবাহিকতায় আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে শুরু হয়েছে আসন ভাগাভাগির খেলা। আন্দোলনের জোট, নির্বাচনি জোট, চেতনাভিত্তিক দলীয় জোট-বিভিন্ন ফরম্যাটে আসন ভাগাভাগির খেলায় মেতে ওঠে দলগুলো। সেই খেলায় এবার বেকাদায় পড়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি। এমনিতেই প্রতিটি আসনে নিজ দলের ১০ থেকে ১২জন প্রার্থী। তার ওপর জোট শরিকদের আবদারে বিএনপির এখন ত্রাহি অবস্থা।

বিজ্ঞাপন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত বিএনপির মিত্র ৩৪টি রাজনৈতিক দল দুই শতাধিক আসন চেয়ে তালিকা দিয়েছে। তবে যেসব দল মনোনয়ন চেয়ে তাদের দলীয় প্রার্থীর তালিকা জমা দিয়েছে তাদের বেশিরভাগই এককভাবে নির্বাচন করলে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সেজন্য তারা বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে নির্বাচনের মতো কঠিন পথ পাড়ি দিতে চায়। এদিকে জামায়াতে ইসলামী বেশকয়েকটি ইসলামী দল নিয়ে জোট করার কারণে অনেকটা চাপে বিএনপি। তাই তারাও চাচ্ছে নির্বাচনি জোটে দলের সংখ্যা বাড়াতে। আর এই সুযোগে ছোট দলগুলো বড় দাবি করে বসে আছে।

জানা গেছে, দলগুলো দুই শতাধিক আসন দাবি করলেও সব মিলিয়ে ২০ থেকে ২৫টি আসন বরাদ্দ দিতে পারে বিএনপি। আর এনসিপি যদি জোটে ভেড়ে তাদের জন্য হয়তো আরও ১০/১২টা আসন ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে সর্বসাকুল্যে ৪০টির বেশি আসন ছাড়ার সম্ভাবনা নেই জোট শরিকদের। তবে বিএনপি নেতারা বলছেন, এটি কোনো জোট নয়। নির্বাচনি সমঝোতা। নির্বাচনের পর যারা বিজয়ী হবে তাদের নিয়ে সরকার গঠন করা হবে। আর এসব দলকে কতটা আসন ছাড়া হবে তা এখনো ঠিক হয়নি।

কারা কত আসন চায়

যেসব দল আসন চেয়ে বিএনপিকে তালিকা দিয়েছে সেগুলো হলো- আসম আব্দুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, সাইফুল হকের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলন, শেখ রফিকুল ইসলাম বাবুলের ভাসানী জনশক্তি পার্টি ও হাসনাত কাইয়ুতের নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। এই ছয়টি দলের জোট হলো গণতন্ত্র মঞ্চ। এই জোট আসন চেয়েছে ১৪০টি। তারা বলেছে এটা তাদের প্রাথমিক তালিকা। এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে পরে সিদ্ধান্ত হবে। তবে বিএনপি বলছে, এই জোট এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কাছে কোনো তালিকা জমা দেয়নি।

এদিকে ১২ দলীয় জোটে আছে- জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, বাংলাদেশ এলডিপি সভাপতি শাহাদাত হোসেন সেলিম, বাংলাদেশ জাতীয় দল সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা, ইউনাইটেড লিবারেল পার্টি-সভাপতি আমিনুল ইসলাম, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি (একাংশ) সভাপতি শামসুদ্দিন পারভেজ, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) সভাপতি ডা. সৈয়দ নুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ জাস্টিস পাটি (বাজাপা) সভাপতি ড. সৈয়দ জাভেদ মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (একাংশ) কে এম আবু তাহের, ন্যাশনাল লেবার পার্টি—সভাপতি লায়ন ফারুক রহমান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সভাপতি মুফতি মহিউদ্দিন ইকরাম, ইসলামী ঐক্যজোট (একাংশ) সভাপতি মাওলানা আবদুর রকীব, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টির সভাপতি আবুল কাসেম। এই জোটের দাবি ২১ আসন।

১১ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের দলগুলো হলো ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) সভাপতি অ্যাডভোকেট ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) একাংশের সভাপতি খন্দকার লুৎফর রহমান, ডেমোক্রেটিক লীগ সভাপতি খোকন চন্দ্র দাস, পিপলস লীগ সভাপতি গরিবে নেওয়াজ, ইসলামী ঐক্যজোট একাংশের সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুর রকিব, বাংলাদেশ ন্যাপ একাংশের সভাপতি এম এন শাওন সাদেকী, বিকল্পধারা বাংলাদেশ একাংশের সভাপতি নুরুল আমিন ব্যাপারী, সাম্যবাদী দল সেক্রেটারি নূরুল ইসলাম, গণদলের সভাপতি এ টি এম গোলাম মাওলা চৌধুরী, ন্যাপ ভাসানীর সভাপতি আজহারুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ মাইনরিটি পার্টির সভাপতি সুকৃতি মণ্ডল। এই জোট নয়টি আসন চেয়ে তালিকা জমা দিয়েছে।

এরপর আছে কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এলডিপি। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনের তালিকায় এক নম্বরে থাকা এই দলটি বিএনপির কাছে ১৩টি আসন চায়। এই দলের মহাসচিব বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী ড. রেদোয়ান আহমেদ লন্ডনে গিয়ে সরাসরি তারেক রহমানের হাতে এই তালিকা দিয়েছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া, আন্দালিভ রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বিজেপি পাঁচটি আসন চেয়েছে। গণফোরাম চেয়েছে ১৫টি আসন। বাংলাদেশ লেবার পার্টি সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পেয়েছে। তারা আনারস প্রতীকে নির্বাচন করবে। বিএনপির কাছে ছয়টি আসন চেয়েছে। ২০১৮ সালে এই দলের চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরানকে পিরোজপুর-২ আসন থেকে মনোনয়ন দিয়েছিল বিএনপি জোট। এবার তিনি ঝালকাঠি-১ আসন দাবি করেছেন। জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)। এই দলের চেয়ারম্যান আলোচিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের ছেলে ববি হাজ্জাজ। তারা ১০টি আসনে মনোনয়ন চেয়ে তালিকা জমা দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দলটির প্রতীক সিংহ।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি দুই পাশে দুটি জোট নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ৩০০ আসনের মধ্যে তখন তাদের বড় শরিক জামায়াতে ইসলামীকে ২২টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল। এ ছাড়াও জামায়াত স্বতন্ত্রভাবে আরও ১৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’কে ১৯টি এলডিপিকে পাঁচটি, খেলাফত মজলিসকে দুটি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে তিনটি, জাতীয় পার্টিকে (কাজী জাফর) দুটি, বিজেপি, কল্যাণ পার্টি, এনপিপি, লেবার পার্টি ও পিপিবিকে একটি করে মোট পাঁচটি আসন ছেড়ে দিয়েছিল। সব মিলিয়ে ওই নির্বাচনে মোট ৫৮টি আসন ছেড়ে দেয় দলটি। এই দলগুলোর মধ্যে গণফোরাম ছাড়া বাকি সব দলের প্রার্থী লড়েছিলেন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে। গণফোরামের একজন আর জামায়াতের দু’জন ছাড়া কেউ বিজয়ী হননি।

যা বলছেন জোট শরিকরা

এবারের নির্বাচনে কমিশনের আইন অনুযায়ী জোটের প্রার্থী হলেও নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। ফলে ছোট দলগুলোর ধানের শীষের ছায়াতলে গিয়ে এমপি হওয়া হবে না। কারণ, নিজস্ব প্রতীকে তারা যখন নির্বাচনে অংশ নেবেন তখন প্রতিপক্ষের জয় তুলে নেওয়া সহজ হবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা ১০০ আসনের প্রার্থী তালিকা দেব। এবং এটি খুব শিগগিরই। আমাদের প্রার্থীরা সারাদেশে কাজ করছেন। যেহেতু বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করছি, সেহেতু তারা আমাদের কাছে তালিকা চেয়েছে। আশা করি তারা আমাদের দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের বিষয়টি মূল্যায়ন করবে।’ তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. ইরানকে ঝালকাঠি-১ আসন ছেড়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা সারাবাংলাকে বলেন, ‘মিত্রদলগুলোর চাহিদা দেখে আমি স্তম্ভিত। জোট করি বলেই আসন দিতে হবে এই দাবির সাথে আমি একমত নই। যোগ্য এবং যাদের নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাদেরই বিএনপির কাছে আসন দাবি করা উচিত। অযৌক্তিকভাবে আসন দাবি করে নির্বাচনি জোট গঠন প্রক্রিয়াকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া উচিত হবে না।’

জোট সঙ্গীদের বিএনপি কতটি আসন ছাড়তে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি বিএনপির বিষয়। তারা জোটকে কতটি আসন ছাড়তে পারবে এখনই বলা যাচ্ছে না। যেহেতু এবার শক্ত জরিপ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে প্রার্থী দিতে চাচ্ছে বিএনপি তাই কতগুলো ছাড়বে সেটা তারাই বলতে পারবে।

বিএনপির পক্ষ থেকে যা বলা হচ্ছে

এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু সারাবাংলাকে বলেন, ‘সবাই যার যার মতো করে আসন চাচ্ছে। বিএনপি এগুলো পর্যবেক্ষণ করবে। কার আসনে কতটা সামর্থ্য আছে সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।’ এত আসন দাবি করা কতটা যৌক্তিক? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা যেমন যৌক্তিক নয়, তেমন প্রাসঙ্গিকও নয়। আর কোন দলকে কত আসন দেওয়া হবে সেটাও বলার সময় হয়নি।’

আসন বণ্টন বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘মানুষের স্বাভাবিক প্রত্যাশা থাকে অনেক। কিন্তু প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির অনেক ব্যবধানও থাকে।’ তিনি বলেন, ‘মূল স্টেক হোল্ডার যারা আমাদের সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামে ছিল, তারা এখনো আসন চায়নি। তবে কয়েকটি ছোট দল চেয়েছে। তাদেরগুলো যাচাই করে দেখা হচ্ছে। কারা সত্যিকার অর্থে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারবেন সে খোঁজ-খবরও নেওয়া হচ্ছে।’

মূল স্টেক হোল্ডার কারা?- জানতে চাইলে আলাল বলেন, ‘গণতন্ত্র মঞ্চ, গণঅধিকার পরিষদ, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যসহ বেশ কয়েকটি দল আছে।’

সারাবাংলা/এমএমএইচ/পিটিএম
বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর