Monday 20 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যেভাবে আন্তর্জাতিক পর্ন তারকা হয়ে উঠলেন বাংলাদেশি যুগল

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২০ অক্টোবর ২০২৫ ১৬:২৩ | আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৫ ১৭:২৭

পর্ন তারকা যুগল। কোলাজ ছবি: সারাবাংলা

ঢাকা: বিশ্ব প্লাটফর্মে অষ্টম স্থান অর্জনকারী পর্নোগ্রাফির সঙ্গে জড়িত আলোচিত বাংলাদেশি পর্ন-তারকা যুগলকে বান্দরবান থেকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি (ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট)। তাদের নিয়ে সম্প্রতি ‘দ্য ডিসেন্ট’ নামের বিদেশি একটি গনমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিষয়টি আলোচনায় আসে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, ২৮ বছর বয়সী এক নারী যার নাম ইংরেজিতে ‘বি’ দিয়ে শুরু এবং ‘ই’ দিয়ে শেষ (এই প্রতিবেদনে তাকে বি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে)—নিজেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বাংলাদেশের এক নম্বর মডেল’ হিসেবে উপস্থাপন করেন। তবে বাস্তবে, তিনি আন্তর্জাতিক পর্ন ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এডাল্ট ওয়েবসাইটগুলোর একটিতে ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসের ১৬ তারিখ পর্যন্ত তিনি বিশ্বব্যাপী পারফর্মারদের মধ্যে অষ্টম স্থানে রয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

তিনি প্রথম ভিডিওটি আপলোড করেন ২০২৪ সালের ১৭ মে তারিখে। চলতি অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি মোট ১১২টি ভিডিও প্রকাশ করেছেন, যা একত্রে ২৬৭ মিলিয়নেরও বেশি ভিউ পেয়েছে। পর্ন ওয়েবসাইটগুলো যেসব বাংলাদেশি নারী পারফর্মার রয়েছেন তারা তাদের পরিচয় ও চেহারা গোপন রাখলেও, বি তার ভিডিওতে মুখ উন্মুক্ত রাখেন এবং তার সঙ্গী যার নাম ইংরেজিতে ‘এ’ দিয়ে শুরু এবং ‘এম’ দিয়ে শেষ (এই প্রতিবেদনে তাকে ‘এ’ হিসেবে উল্লেখ) তার সাথেও একসঙ্গে পর্ন ভিডিওতে হাজির হন।

বি এবং এ কেবল একটি প্ল্যাটফর্মেই সীমাবদ্ধ নন; তাদের ভিডিওগুলো একাধিক আন্তর্জাতিক পর্ন ওয়েবসাইটে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। তারা নিজেদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্টগুলোকে খুবই পরিকল্পিতভাবে তাদের কনটেন্ট প্রচারের জন্য ব্যবহার করেন।

দ্য ডিসেন্ট অক্টোবরের প্রথম দুই সপ্তাহে বিভিন্ন ফেসবুক পেইজে অন্তত ৫০টি পোস্ট তালিকাভুক্ত করেছে, যেখানে বি এবং এ-এর পর্নোগ্রাফিক ভিডিওগুলো নানাভাবে প্রচার করা হচ্ছে। তবে এসব পেইজ তারা নিজেরা পরিচালনা করেন কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

বাংলাদেশের পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ অনুযায়ী, পর্নোগ্রাফি উৎপাদন ও বিতরণ একটি ফৌজদারি অপরাধ। এই যুগল শুধু নিজেরাই অপরাধই করছে না, বরং অন্যদেরও এই পথে যুক্ত হতে উৎসাহিত করছেন, যার মাধ্যমে বাংলাদেশে বসে পর্ন ভিডিও বানানো এবং প্রচারের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে উঠছে।

তদন্তে এ-কে চিহ্নিত করা হয়েছে বাংলাদেশে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই কার্যক্রমের মূল ব্যক্তি হিসেবে। এ দ্য ডিসেন্ট-কে জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত তার পর্নোগ্রাফি-সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য কোনো প্রশাসনিক পদক্ষেপের মুখোমুখি হতে হয়নি।

এ-এর নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা এক ভিডিওতে দেখা গেছে—সাধারণ নারীর মতো কুর্তা ও ওড়না পরিহিত এক তরুণী দর্শকদের উদ্দেশে আহ্বান জানাচ্ছেন, ‘আমাদের প্রাইভেট ভিডিও গ্রুপে কী আছে জানতে চান? নিচে ভিডিওর বিবরণ দেওয়া হলো।’ এ ধরণের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই বি এবং এ তাদের সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এসব পর্নোগ্রাফির প্রচারণা চালান।

দ্য ডিসেন্ট এই পর্নস্টার যুগলকে শনাক্ত করার চেষ্টা করেছে যারা সম্ভবত বাংলাদেশে নিজেদেরকে উন্মুক্ত রেখে এ ধরনের কাজ করা প্রথম উদাহরণ। এ-এর জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী, তিনি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন। এই তথ্য অনুসরণ করে দ্য ডিসেন্ট তার গ্রামে যায় এবং স্থানীয়দের সহায়তায় তার বাড়িটি খুঁজে পায়।

স্থানীয় এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, এ-কে তিনি চেনেন। অটোরিকশা চালক এবং এ-এর প্রতিবেশী মো. ফারুক বলেন, ‘তার পুরো পরিবার বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তারা অপরাধী পরিবার বলে এলাকায় পরিচিত। সে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অনলাইন ব্যবসা করে।’

দ্য ডিসেন্ট যখন এ-এর বাড়িতে যায়, সেটি তালাবদ্ধ ছিল। পাশের বাড়ির এক নারী জানান, পরিবারটি নিয়মিত সেখানে থাকে না। মাঝে মাঝে অল্প সময়ের জন্য আসে।

অন্যদিকে, বি-এর জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী, তিনি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার বাসিন্দা। এই প্রতিবেদক উল্লেখিত ঠিকানায় গেলে দেখা যায়, সেটি তার প্রথম স্বামীর বাড়ি তার শ্বশুর নিশ্চিত করেন যে, বি তার ছেলের বউ ছিলেন। কিন্তু একদিন সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, আট বছর হয়ে গেছে কিন্তু আর ফিরে আসেনি।

বি-এর বাবার একই উপজেলার ভিন্ন একটি গ্রামে। মেয়ের বিষয়ে এ প্রতিবেদকের কথা বলতে বিব্রতবোধ করেন বাবা। তিনি জানান, এক বছর আগে তিনি বি-এর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। আমরা গত এক বছর ধরে বি-এর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখিনি। আমি তাকে ত্যাজ্য করেছি।

দ্য ডিসেন্ট নিশ্চিত হয়েছে যে, বিগত কয়েক মাস ধরে যুগলটি চট্টগ্রাম শহরে এবং এর পাশের অন্তত দুটি জায়গায় বসবাস করেছেন।

দ্য ডিসেন্ট-কে এ বলেছেন, ‘আমার বাবা-মা ও পরিবারের সবাই জানে যে আমরা পর্ন ভিডিও বানাই।’ পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী, গত ২৫ আগস্ট এ-কে মাদক-সংক্রান্ত একটি মামলায় (ধারা ১৫১ অনুযায়ী) গ্রেফতার করা হয়েছিল চট্টগ্রামে আনোয়ারা থানায় দায়ের করা একটি সাধারণ ডায়েরির ভিত্তিতে। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি মুক্তি পান।

এ বলেন, বি আমার স্ত্রী, আমরা কয়েক বছর আগে বিয়ে করেছি। এ-কে যখন জিজ্ঞেস করা হয় তিনি কি বি-কে জোরপূর্বক এই কাজে বাধ্য করেছেন কিনা? এর উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, ‘সব কিছু তো আপনাকে বলব না।’

তবে বি-এর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, সেখানে বেশ কিছু পোস্ট ও ভিডিও রয়েছে যেখানে তিনি নিজের কাজের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করেছেন। গত ১১ অক্টোবর, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম উভয় অ্যাকাউন্টে শেয়ার করা এক পোস্টে বি লিখেছেন: ‘আমি এই পথে হাঁটছি কেন? কেউ কি জানতে চায়? আমার জীবনের গল্প বললে, যে কোনো মেয়ে কাঁদবে!’

দ্য ডিসেন্ট-এর তথ্যানুযায়ী, এ-এর তিন ভাই রয়েছেন। বড় ভাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার রেকর্ড নেই। তবে অন্য দুই ভাই এবং তাদের বাবা অপরাধের রেকর্ড রয়েছে।

পুলিশের তথ্যমতে, এ-এর দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ডাকাতিসহ মোট আটটি মামলা রয়েছে।

তদন্তে দেখা গেছে, বি-এর নামে তৈরি একটি যৌথ টেলিগ্রাম চ্যানেল ২২ মে ২০২৪ সালে খোলা হয়, যেখানে বর্তমানে প্রায় ২,০০০ সদস্য রয়েছেন। দ্য ডিসেন্ট নিশ্চিত হয়েছে যে, এই চ্যানেলটি বি এবং এ যৌথভাবে পরিচালনা করেন। এই চ্যানেলে নিয়মিত তাদের পর্নোগ্রাফিক ভিডিও সংক্রান্ত কনটেন্ট শেয়ার করা হয়।

প্রতিবার নতুন ভিডিও প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তারা লিংকটি ওই চ্যানেলে এবং অন্যান্য সোশাল প্লাটফর্মের তাদের একাউন্টে শেয়ার করেন। ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দ্য ডিসেন্ট প্রায় ৭০টি ভিডিও লিংক সংগ্রহ করেছে, যা বিভিন্ন পর্ন ওয়েবসাইটে তাদের প্রোফাইল থেকে এসেছে।

১৪ জুন ২০২৫-এ, তিনি বি-এর পর্ন প্রোফাইলের ড্যাশবোর্ডের একটি ছবি শেয়ার করেন, যেখানে ২০২৪ সালের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আয় দেখা যাচ্ছে ১৫ হাজার ৭০৩ মার্কিন ডলার (প্রায় ২০ লাখ টাকা)। এক সপ্তাহ পর, ২১ জুন, তিনি আরেকটি ছবি পোস্ট করেন, যেখানে লেখা ছিল: ‘একটি ভিডিও থেকে আয় এক লাখ টাকা।’

বি-এর ফেসবুক আইডিতে প্রায় ৪৯ হাজার ফলোয়ার এবং ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে ১২ হাজারের বেশি অনুসারী রয়েছে। উভয় একাউন্টের বায়ো অংশে তিনি নিজেকে পর্ন ক্রিয়েটর হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন, সরাসরি তার ওয়েবসাইটের লিংক যুক্ত করেছেন এবং দাবি করেছেন, ‘বাংলাদেশের নাম্বার ওয়ান মডেল।’

২০২৫ সালের ১০ অক্টোবর পর্যন্ত তার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে ৩৫৬টি পোস্ট ছিল, যার প্রথমটি প্রকাশিত হয়েছিল ৩ মে ২০২৪ সালে। এই পোস্টগুলোর অনেকগুলোতেই তার পর্ন কনটেন্ট প্রচার করা হয়েছে এবং অনুসারীদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিতে আহ্বান করা হয়েছে।

পর্ন ওয়েবসাইটগুলো কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের অর্থ প্রদান করে, আবার নতুন সদস্য যোগ করার জন্য রেফারেল ইনসেনটিভও দেয়। ‘আমরা যদি নতুন ক্রিয়েটর যোগ করতে পারি, ওয়েবসাইট আমাদের ডলারে বোনাস দেয়,’ দ্য ডিসেন্ট-কে বলেন এ।

১৮ জুন এ আরেকটি পোস্টে লেখেন: ‘যে কেউ টাকা আয় করতে চাও, ইনবক্স করো।’ পরে ২৮ জুলাই বি পোস্ট করেন: ‘মডেল অ্যাড করো, ৫৫ ডলার ফ্রি। আগ্রহী হলে ইনবক্স করো।’

দ্য ডিসেন্ট-কে এ বলেন, গত বছর মার্চের দিকে আমি টেলিগ্রামে এক ভারতীয় ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হই। সে আমাকে অনলাইনে শিখিয়েছিল কীভাবে ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুলে আয় করা যায়। তখনই আমি অ্যাকাউন্ট খুলে ভিডিও আপলোড শুরু করি।

অনুসন্ধানে আরও অন্তত পাঁচজন পর্ন কনটেন্ট ক্রিয়েটর শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে, যাদের বেশিরভাগ চট্টগ্রামভিত্তিক। তবে বি ও এ-এর মতো তারা মুখ দেখাননি, ফলে তাদের সঠিক পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি।

সারাবাংলা/এমএইচ/এনজে
বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর