ঢাকা: পুঁজিবাজারে ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটে তালিকাভুক্ত কোয়েস্ট বিডিসির (সাবেক পদ্মা প্রিন্টার্স অ্যান্ড কালার) কার্যক্রম পরিচালনায় অনিয়ম, দুর্নীতি ও আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গঠিত অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে কোয়েস্ট বিডিসির পরিচালক ও এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলাম ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে পুঁজিবাজারসংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে আজীবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে তার সহযোগী পরিচালনা পর্ষদের পাঁচ সদস্য ও ট্রাস্টিকে মোট ১০৯ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সভাপতিত্ব অনুষ্ঠিত ৯৭৮তম কমিশন সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালামের সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ লিমিটেডের নিবন্ধন বাতিল, রিয়াজ ইসলাম, তার সহযোগী পরিচালনা পর্ষদের পাঁচ সদস্য ও ট্রাস্টিকে মোট ১০৯ কোটি টাকা জরিমানা, মানিলন্ডারিং সংঘটিত হওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ প্রেরণ এবং নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি।
কোয়েস্ট বিডিসির পর্ষদের অন্য সদস্যরা হলেন- রেজাউর রহমান সোহাগ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহসান (অব.), মদিনা আলী, সৈয়দ কামরুল হুদা ও মো. ওমর সোয়েব চৌধুরী। বিএসইসির গঠিত অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, স্টক এক্সচেঞ্জের মূল বোর্ড হতে তালিকাচ্যুত পদ্মা প্রিন্টার্স অ্যান্ড কালার লিমিটেডের ৫১ শতাংশ শেয়ার অধিগ্রহণের নিমিত্ত ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ার ২৮৯ দশমিক ৪৮ টাকা দরে ক্রয়ের মাধ্যমে এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃক পরিচালিত ছয়টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড যথা: এনসিসিবিএল মিউচুয়াল ফান্ড-১, এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ মিউচুয়াল ফান্ড ওয়ান, এআইবিএল ফার্স্ট ইসলামিক মিউচুয়াল ফান্ড, এমবিএল ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, গ্রিন ডেল্টা মিউচুয়াল ফান্ড থেকে ২৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়।
ওই বিনিয়োগের সময় পদ্মা প্রিন্টার্স অ্যান্ড কালার লিমিটেডের ব্যবসায়িক কার্যক্রম ছিল না। এছাড়াও এসময় প্রতিষ্ঠানটির প্রতি শেয়ারের নিট অ্যাসেট ভ্যালু (এনএভি) ছিল নেগেটিভ ২ দশমিক ৭৪ টাকা এবং নেগেটিভ রিটেন আর্নিং ছিল ২ দশমিক ৩৫ কোটি টাকা (৩০ জুন ২০২২ অনুযায়ী)। ওই বিনিয়োগের অব্যবহিত পূর্বে ডিএসইর ওটিসি প্ল্যাটফর্মে কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের ট্রেডিং প্রাইস ছিল মাত্র ১৩ দশমিক ৬০ টাকা। পরবর্তী সময়ে মিউচ্যুয়াল ফান্ডসমূহ থেকে মনোনীত পরিচালকের (যারা ফান্ডের সাথে কোনোভাবেই স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয় বরং এল আর গ্লোবাল বাংলাদেশের স্বার্থপুষ্ট ব্যক্তি) মাধ্যমে কোম্পানির বোর্ড গঠন করা হয় এবং কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে ‘কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেড’ নামকরণ করা হয়।
সেইসঙ্গে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ১ দশমিক ৬০ কোটি টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। ওই ছয়টি ফান্ড হতে প্রতিটি শেয়ার ১৫ দশমিক ৮৮ টাকা মূল্যে মোট ৪৫ দশমিক ০২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়। এ সময় কোম্পানির বিদ্যমান আগের শেয়ারহোল্ডারকে কোনো শেয়ার দেওয়া হয়নি। এছাড়াও, উল্লিখিত ক্ষেত্রে বিধি মোতাবেক প্রাইস সেনসেটিভ ইনফরমেশন প্রকাশ করা হয়নি, বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) করা হয়নি এবং প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ইস্যুকৃত শেয়ার লক ইন করা হয়নি। উল্লিখিত ছয়টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড থেকে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে না থাকা এমন লোকসানি কোম্পানিতে ৬৮ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে ইউনিটহোল্ডারদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হয়।
এ পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন জড়িতদের বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত শাস্তিমূলক সিদ্ধান্ত নিয়েছে-
১. প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে পরিশোধিত মূলধন ১ দশমিক ৬০ কোটি টাকা হতে ৫০ কোটি টাকায় উন্নীত করার ক্ষেত্রে বিধি অনুযায়ী প্রাইস সেনসেটিভ ইনফরমেশন প্রকাশ না করা, ইজিএম না করা এবং প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ইস্যুকৃত শেয়ার লক ইন না করার মাধ্যমে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের দায়ে কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেডের তৎকালীন পরিচালক যথা: রিয়াজ ইসলাম-ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতিনিধি পরিচালক, রেজাউর রহমান সোহাগ-গ্রীন ডেল্টা মিউচুয়াল ফান্ডের চেয়ারম্যান ও প্রতিনিধি পরিচালক, শরীফ আহসান, তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এআইবিএল প্রথম ইসলামিক মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতিনিধি পরিচালক, মিসেস মদিনা আলী-এমবিএল প্রথম মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতিনিধি পরিচালক, সৈয়দ কামরুল হোদা এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ মিউচুয়াল ফান্ড ওয়ানের প্রতিনিধি পরিচালক ও মো. ওমর সোয়েব চৌধুরী-এনসিসিবিএল মিউচুয়াল ফান্ড-১ এর প্রতিনিধি পরিচালক প্রত্যেককে ১ কোটি টাকা করে অর্থদণ্ড আরোপ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
২. এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড ব্যবস্থাপনা করা ওই ছয়টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে বিনিয়োগকৃত অর্থ সুদসহ মোট ৯০ কোটি টাকা ফান্ডগুলোর বিনিয়োগের অনুপাতে ৩০ দিনের মধ্যে ওই ফান্ডগুলোতে ফেরত আনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এলআর গ্লোবালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলাম ওই অর্থ ফান্ডগুলোতে ফেরত আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। ওই সময়ের মধ্যে এ অর্থ ফেরত আনতে ব্যর্থ হলে অর্থদণ্ড প্রদানের আদেশের তারিখ থেকে এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের পরিচালক ও সিইও রিয়াজ ইসলামকে ৯৮ কোটি টাকা এবং পরিচালক মি. জর্জ এম. স্টককে এক কোটি টাকা ও পরিচালক রেজাউর রহমান সোহাগকে এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড আরোপ করারও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
৩. বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (মিউচ্যুয়াল ফান্ড) বিধিমালা, ২০০১ এর বিধান ভঙ্গ করে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে না থাকা এবং এনএভি ও রিটেন আর্নিং নেগেটিভ এমন দুর্বল কোম্পানির একক শেয়ারে বিনিয়োগ করায় ওই ছয়টি ফান্ডের ইউনিটহোল্ডারদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে জনস্বার্থে ছয়টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপক হিসেবে এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের নিয়োগ বাতিলের প্রক্রিয়া শুরুর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
৪. উল্লিখিত ছয়টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের যথাযথ তদারকি ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে ইউনিটহোল্ডারদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ায় ফান্ডগুলোর ট্রাস্টি বাংলাদেশ জেনালেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডকে (বিজিআইসি) তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ড করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
৫. মিথ্যা তথ্য প্রদান করায় কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেড’র তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান রেজাউর রহমান সোহাগকে ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
৬. কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেড এর ৩০ জুন ২০২৩ সমাপ্ত আর্থিক বছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রদানের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ায় নিরীক্ষক শফিক বসাক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিষয়টি ফাইনান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলে (এফআরসি) প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
৭. একই সময়ে ৩টি প্রতিষ্ঠান যথা: সোনালী সিকিউরিটিজ লিমিটেড ও কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেড এর তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং এআইবিএল ফার্স্ট ইসলামিক মিউচুয়াল ফান্ডের তৎকালীন পরিচালকের দায়িত্বে থাকায় সৃষ্ট স্বার্থের সংঘাত থাকার কারণে শরীফ আহসানকে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
৮. ছয়টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে ২৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা তৎকালীন পদ্মা প্রিন্টার্স অ্যান্ড কালার লিমিটেডে বিনিয়োগের বিষয়টি অনুমোদন এবং কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেড এর পরিশোধিত মূলধন ১ দশমিক ৬০ কোটি টাকা হতে ৫০ কোটি টাকায় উন্নীত করার বিষয়টি অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় অনৈতিক যোগসাজশ থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ও এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলামকে পুঁজিবাজারের কার্যক্রম থেকে আজীবন নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
৯. কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেড প্রতিটি ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার প্রতিটি ৫২ দশমিক ২৫ টাকা করে মোট ২৪ দশমিক ৯৫ কোটি টাকা থাইরোকেয়ার বাংলাদেশ লিমিটেড-এ বিনিয়োগ করা হয়। এই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শেয়ার মূল্যায়ন করেছেন সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল রিসোর্স লিমিটেডের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এরশাদ হোসেন ও এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলামের যোগসাজশের প্রেক্ষিতে ওই শেয়ার মূল্যায়ন করা হয়। শেয়ার মূল্যায়নের মাধ্যমে কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেড থেকে ২৪ দশমিক ৯৫ কোটি টাকা থাইরোকেয়ার বাংলাদেশ লিমিটেড-এ হস্তান্তরিত হয়। যার মাধ্যমে মানিলন্ডারিং সংঘটিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হওয়ায় বিষয়টি অধিকতর তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
উল্লেখ্য, বিগত সরকারের আমলে আইন বা বিধি-বিধান লঙ্ঘন করা মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুনর্গঠিত বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।