রাজবাড়ী: সদর উপজেলার বাণীবহ ইউনিয়নের শিবরামপুর গ্রাম। সবুজে ঘেরা গ্রামটি এখন অতিথি পাখিদের কূজনে মুখর। পুরো গ্রামজুড়ে শুধু পাখির কলকাকলি। ডানার ঝাপটানোর আর কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত চারপাশ। শীত শুরুর আগেই তারা এসে জড়ো হয়েছে। লম্বা পা ও হালকা ধূসর বর্ণের ঠোঁটওয়ালা পাখিগুলো দেখতেও বেশ। প্রকৃতির অপরূপ মনোমুগ্ধকর এ দৃশ্য দেখতে ছুটে আসছেন প্রকৃতি ও পাখিপ্রেমীরা। গ্রামের মানুষের ভালোবাসা আর নিরাপত্তা পেয়ে দিনদিন বাড়ছে এই পাখির সংখ্যা।
জানা গেছে, এখানকার বেশিরভাগ পাখি হলো শামুকখোলা বা ওপেনবিল স্টর্ক, পানকৌড়ি ও সারস। এই অতিথি পাখির প্রধান খাদ্য শামুক। প্রতিদিন সকালে পাখিগুলো আশপাশের জলাশয়, বিল ও পুকুরে যায় খাবারের সন্ধানে, আবার খাবার নিয়ে নীড়ে ফেরে বিকেলে বা সন্ধ্যায়।

অতিথি পাখির আগমনে মুখর রাজবাড়ীর শিবরামপুর গ্রাম। ছবি: সারাবাংলা
সরেজমিনে দেখা গেছে, শিবরামপুরের করবাড়ির পুকুরের চারপাশ গাছ-গাছালিতে ঘেরা। এসব গাছের ডালে বাসা বেঁধেছে অতিথি পাখি। প্রায় প্রতিটি বাসায় রয়েছে ডিমসহ পাখির বাচ্চা। কেউ বাসা বানাচ্ছে, কেউ ডিমে তা দিচ্ছে, কেউ আবার ছানা লালনপালন করছে। সাদা রঙের এ পাখিরা কিচিরমিচির করে গাছের এপাশ-ওপাশ উড়ছে। কয়েক হাজার পাখির এমন ওড়াউড়ির দৃশ্য মুহূর্তেই নৈসর্গিক হয়ে ওঠে।
পাখিগুলোর আগমনে বাগান মালিক ও প্রকৃতিপ্রেমীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসছে এই পাখি ও তাদের আবাসস্থল দেখতে। অনেকে আবার তাদের ক্যামেরায় তুলছেন পাখির ছবি। তবে কিছু অসাধু ব্যক্তি পাখি শিকার বা বিরক্তের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

অতিথি পাখির আগমনে মুখর রাজবাড়ীর শিবরামপুর গ্রাম। ছবি: সারাবাংলা
পাখিরা যেখানে বাসা বেঁধেছে, তার সঙ্গের বাড়িটি আকাশ করের। সারাবাংলাকে তিনি জানান, প্রায় আট মাস ধরে অতিথি পাখির আগমন ঘটেছে। এখানে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার পাখি আছে। এরা দিনে খাবারের সন্ধানে বের হয়, বিকেলের মধ্যে ফিরে আসে। সারাক্ষণ কিচিরমিচির শব্দ। অনেক ভালো লাগে, যা বোঝানোর মতো নয়।
দর্শনার্থী দুলাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘অতিথি পাখির খবর পেয়ে আমি জামালপুর থেকে এখানে দেখতে এসেছি। এই পাখিগুলো রক্ষা করতে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করুক। কারণ, পাখিগুলো আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।’
রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান সারাবাংলাকে জানান, পরিযায়ী পাখি শীতপ্রধান দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে আসে। খাবার সংকট, বংশবৃদ্ধি ও পরিবেশগত সমস্যার কারণে তারা এখানে আসে। বংশবৃদ্ধি হয়ে গেলে তারা উপযুক্ত আবহাওয়ায় ফিরে যায়। এরা শামুক, ছোট মাছ, পোকামাকড় খেয়ে জীবন ধারণ করে। এসব পাখি পরিবেশের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এরা মলত্যাগ করলেও মাটির উর্বরতা বাড়ে।

অতিথি পাখির আগমনে মুখর রাজবাড়ীর শিবরামপুর গ্রাম। ছবি: সারাবাংলা
রাজবাড়ী বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মীর সায়েদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিদিন তাদের একজন স্টাফ সেখানে যাচ্ছেন। তাদের নিয়মিত নজরদারি রয়েছে। এলাকার লোকদের সচেতন করছেন। আগে পাখি শিকারের যে প্রবণতা ছিল, সেটি বন্ধ হয়েছে।’
রাজবাড়ীর জীব ও পাখি নিয়ে কাজ করা সংগঠন আরামঘর জীববৈচিত্র্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা লিটন চক্রবর্তী সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘শুনেছি ওখানকার অনেক উঁচু উঁচু গাছ থেকে পাখিগুলো পড়ে আহত হচ্ছে। সেই পাখি কেউ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, আবার কেউ খেয়ে ফেলছে। সে ক্ষেত্রে কেউ যদি অসুস্থ পাখি পেয়ে আমাদের কাছে দেয় তাহলে আরাম ঘরের মাধ্যমে পাখিকে সুস্থ করে প্রশাসনের মাধ্যমে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করতে পারব।’

অতিথি পাখির আগমনে মুখর রাজবাড়ীর শিবরামপুর গ্রাম। ছবি: সারাবাংলা
রাজবাড়ী সামাজিক বনায়ন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মীর সায়েদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাখিগুলো নিয়মিত নজরদারির মধ্যে রয়েছে। কোনো দুষ্কৃতিকারী যেন পাখিগুলোর ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য টহল কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। পাখির নিরাপত্তায় প্রতিদিন অফিসের একজন স্টাফ বিকেল থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত দ্বায়িত্ব পালন করছে। এছাড়া, বিষয়টি জেলা প্রশাসন এবং বিভাগীয় বন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। জনসচেতনতা তৈরিতে ওই এলাকায় মাইকিংসহ সাইনবোর্ড স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘সদর উপজেলার বাণীবহ ইউনিয়নে একটি বাড়িতে অতিথি পাখি অবস্থান করছে। পাখিগুলো সংরক্ষণের জন্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বন বিভাগকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।’