চট্টগ্রাম ব্যুরো: কখনো বেতন-ভাতা নিয়ে অসন্তোষ বা তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে বিশৃঙ্খলা, কখনোবা শ্রমিকের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে দেওয়া, আবার কখনো কারখানা কর্তৃপক্ষ কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হয়রানি— এমন নানা গুজব ছড়িয়ে পরিকল্পিতভাবে চট্টগ্রামের পোশাক শিল্পে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে।
শিল্প মালিকদের দাবি, রফতানিমুখী এ-ওয়ান ক্যাটাগরির পোশাক কারখানাগুলোকে টার্গেট করেই অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। গুজবকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সম্প্রতি চট্টগ্রামে আটটি ‘ভিআইপি কারখানা’ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছিল। যদিও সাতদিন পর সেগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সূত্রমতে, পরিকল্পনা করে এ অস্থিরতা সৃষ্টির নেপথ্যে জড়িতদের শনাক্ত করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে জোর তদন্ত শুরু করেছে শিল্প পুলিশ। এক্ষেত্রে পোশাক খাতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর ইন্ধন আছে কী না সেটা যেমন খতিয়ে দেখা হচ্ছে, তেমনি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বর্তমানে কার্যক্রম স্থগিত থাকা আওয়ামী লীগ ও তাদের শ্রমিক সংগঠন কিংবা পোশাক খাত নিয়ে কাজ করা বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার প্রভাবিত কোনো শ্রমিক সংগঠন ইন্ধন জোগাচ্ছে কী না, সেটা বিবেচনায় রেখেছে পুলিশ।
জানতে চাইলে শিল্প পুলিশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুলিশ সুপার (এসপি) আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘একেবারে পরিকল্পিতভাবে চোখের সামনে গুজব ছড়িয়ে শ্রমিকদের উত্তেজিত করা হচ্ছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে বিশেষ করে সিইপিজেড-এ উৎপাদনমুখী কারখানাগুলোতে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। কখনো পুরনো মামলায় শ্রমিকদের গ্রেফতার-হয়রানির ভয় দেখিয়ে মাঠে নামানো হচ্ছে। মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মোটামুটিভাবে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরির যতধরনের চেষ্টা আছে, সবই করা হচ্ছে।’
তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র পরিচালক এম ডি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘পোশাক খাতে বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। মার্কিন ট্যারিফ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পর দেশের পোশাক খাত এগিয়ে যাচ্ছে। এই প্রতিযোগিতাকে নস্যাৎ করার জন্য দেশি-বিদেশি একদল লোক এখানে উঠেপড়ে লেগেছে। বিভিন্ন ধরনের গুজব সৃষ্টি করে তার অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করার চেষ্টা করছে।’
বিজিএমইএ’র দেওয়া তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রামে তাদের সদস্যভুক্ত কারখানার সংখ্যা ৬৯৯টি। সচল ৬১০টি। এর মধ্যে সিইপিজেডে মোট কারখানা ১৪টি এবং কর্ণফুলী ইপিজেডে কারখানার সংখ্যা ৫৫টি। এর বাইরে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় কোরিয়ান ইপিজেডে ৪৮টি কারখানা আছে। এসব কারখানায় প্রায় ১১ লাখ শ্রমিক কাজ করেন।
উৎপাদন, রফতানি ও কর্মসংস্থানের বিবেচনায় চট্টগ্রামে পোশাক শিল্পে প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের বিভিন্ন কারখানা শীর্ষে আছে। গত ১৪, ১৫ ও ১৬ অক্টোবর তিনদিন ধরে সিইপিজেডে ওই গ্রুপের কয়েকটি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গ্রুপটি তাদের আটটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর ২৩ অক্টোবর থেকে সেগুলো ফের চালু হয়েছে।
কারখানাগুলো হলো- প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেড, প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেড (ইউনিট-২), প্যাসিফিক অ্যাটায়ার্স লিমিটেড, প্যাসিফিক অ্যাকসেসরিজ লিমিটেড, এনএইচটি ফ্যাশনস লিমিটেড, জিন্স ২০০০ লিমিটেড, ইউনিভার্সাল জিন্স লিমিটেড এবং প্যাসিফিক ওয়ার্কওয়ার্স লিমিটেড। এসব কারখানায় প্রায় ৩২ হাজার শ্রমিক কর্মরত আছেন।
শিল্প পুলিশের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্যাসিফিক জিন্সের কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে সিইপিজেডের ভেতর পুলিশের সংঘর্ষের একটি ঘটনা ঘটে। দেড় বছর পর এসে ওই মামলায় শ্রমিকদের হয়রানির অজুহাতে গত ১৪ অক্টোবর প্যাসিফিক জিন্সে উত্তেজনা শুরু হয়। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা সবাই কারখানা থেকে বেরিয়ে একযোগে বিক্ষোভ শুরু করেন। পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং বেপজা কর্তৃপক্ষ মিলে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করলেও শ্রমিকরা মামলা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত কাজে যোগ না দেওয়ার বিষয়ে অনড় থাকেন। এক পর্যায়ে প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ তিনটি কারখানা ছুটি ঘোষণা করে।’
পরদিন ১৫ অক্টোবর পুলিশের হয়রানি না করা ও মামলা প্রত্যাহারের আশ্বাস পেয়ে শ্রমিকরা কাজে যোগ দেন। তবে সেদিন আর কারখানা চালু হয়নি। পরদিন শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে শ্রমিকরা কাজে যোগ দেওয়ার পর-পরই ফের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, একদল শ্রমিক কারখানার কর্মকর্তা পর্যায়ের কয়েকজনকে বের করে প্রকাশ্যে মারধর করছেন।
এসপি আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেদিন (১৬ অক্টোবর) শ্রমিকদের মধ্যে একটি ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে, নির্যাতনে তিন শ্রমিক মারা গেছেন। এর প্রতিবাদে দলে দলে শ্রমিকরা কারখানা থেকে বেরিয়ে আসেন। আটটি কারখানার সবগুলোতেই অস্থিরতা তৈরি হয়। এক পর্যায়ে মালিক কারখানাগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। আমরা শ্রমিকদের বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, এগুলো নিছক গুজব, কোনো শ্রমিক মারা যায়নি- কিন্তু শ্রমিকদের শান্ত করা সম্ভব হয়নি।’
এদিকে গুজবের পরিপ্রেক্ষিতে প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের আটটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ৩২ হাজার শ্রমিকের আয়-উপার্জন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন। সূত্রমতে, শিল্প পুলিশের পক্ষ থেকে সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখা করে সদর দফতরে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এরপর অস্থিরতা সৃষ্টির নেপথ্যে কারা বা কোন কোন মহল জড়িত- সেটা তদন্তের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সারাদেশে পোশাক কারখানাগুলোকে সতর্ক নজরদারিতে রাখার নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
এসপি আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, ‘নির্যাতনে তিন শ্রমিকের মৃত্যুর গুজবে যখন উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, তখন আমরা শ্রমিকদের কাছ থেকে এসংক্রান্ত একটি ভিডিও সংগ্রহ করি। ভিডিওতে দেখা গেছে, কাফনের কাপড় মোড়ানো তিনটা লাশ পাশাপাশি রাখা হয়েছে। কাফনের কাপড় এমনভাবে দেওয়া হয়েছে, যাতে লাশগুলোর চেহারা বোঝা না যায়। আমরা বুঝতে পারি, ভিডিওটি পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে। আমরা যেসব শ্রমিকদের কাছে এই ভিডিও পেয়েছি, তারা থার্ড বা ফোর্থ পার্টি। এরা একজন আরেকজনের কাছ থেকে শুনে কিংবা মোবাইলে ভিডিও শেয়ার করে উত্তেজিত হয়েছেন। অর্থাৎ তারা ফাঁদে পা দিয়েছেন।’
‘এরপর আমরা তাদের কারা এই ভিডিও সরবরাহ করেছে, সেটা নিয়ে তদন্তে নামি। বলা যেতে পারে, আমরা গুজবের উৎসের সেকেন্ড লেয়ার পর্যন্ত যেতে পেরেছি। মূল উৎস এখনও পাইনি। তবে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, পরিকল্পিতভাবেই ভিডিওটি ছড়ানো হয়েছে।’ রাজনৈতিক কিংবা মহলবিশেষের কোনো ইন্ধন আছে কী না? জানতে চাইলে এসপি মাহমুদ বলেন, ‘থাকতে পারে। দেশি-বিদেশি চক্রান্ত হতেও পারে। আমরা সম্ভাব্য সবধরনের উৎসের খোঁজে আছি। কিছু তথ্য আমরা পেয়েছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখছি।’
বিজিএমইএ’র পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুপার কমপ্লায়েন্স ফ্যাক্টরিগুলোতে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। এগুলোতে তো কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকার কথা না। রফতানিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য কিছু কুচক্রীমহল এ ধরনের কাজগুলো করছে।’
বিজিএমইএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ রফিক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘কৌশলগত কারণে পোশাক সেক্টরকে বেছে নেওয়া হয়েছে। কারণ, এই সেক্টরে যদি অসন্তোষ হয়, তাহলে এটা বাংলাদেশের জন্য একটা ডিজাস্টারের মতো হবে। এই সেক্টরটা সর্বোচ্চ রফতানি আয়ের একটা সেক্টর। এটাতে যদি আঘাত করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আঘাতটা যাবে।’
শিল্প পুলিশ ও বিজিএমইএ’র দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত একবছরে বেতন-ভাতার আন্দোলন ছাড়াও চট্টগ্রামের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় তুচ্ছ ঘটনা ও গুজবকে কেন্দ্র করে শতাধিক শ্রমিক অসন্তোষ ও এর প্রেক্ষিতে সংঘাতের ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত ১৪ মাসে চট্টগ্রামে ৫০টি পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। অস্থায়ীভাবে বন্ধ আছে ৬১টি কারখানা। এসব কারখানার লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে।