Tuesday 28 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হাসিনার নির্দেশে লগি-বৈঠার তাণ্ডব: ২৮ অক্টোবর রাজনৈতিক ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৮ অক্টোবর ২০২৫ ১০:১২ | আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২৫ ১২:৩০

রাজধানীর পল্টনে সেদিন লগি-বৈঠা দিয়ে হামলা চালায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

ঢাকা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর এক কলঙ্কিত অধ্যায়। রাজধানীর পল্টনে সেদিন লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে নৃশংসভাবে জামায়াত-শিবিরের ছয় নেতাকর্মীকে হত্যা করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। শুধু পিটিয়ে হত্যা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর লাশের ওপর নৃত্য করে বর্বর নারকীয় উল্লাসে মেতে উঠে ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ। আর সেই ঘটনা শুধু বাংলাদেশের রাজনীতিকেই নাড়িয়ে দেয়নি, কাঁপিয়ে দিয়েছিল পুরো বিশ্বকে। আজ আওয়ামী লীগের সেই লগি-বৈঠার তাণ্ডবের ১৯ বছর।

২০০৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করার উদ্দেশ্যে চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষে ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সারাদেশে লগি-বৈঠার তান্ডব সৃষ্টি করে। সেদিন বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একটি জনসভার আয়োজন করা হয়। সকাল থেকে জনসভার স্টেজ নির্মাণের কাজ চলছিল। হঠাৎ ১৪ দলীয় জোটের সন্ত্রাসীরা গোটা পল্টন এলাকায় জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের ওপর লগি-বৈঠা, লোহার রড ও বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এমনকি, খোদ দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা দলীয় নেতাকর্মীদের সমাবেশে লগি-বৈঠা নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন

জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্য শুরু হলে চারদিক থেকে ১৪ দলের সন্ত্রাসীরা গুলি করতে করতে জনসমাবেশের দিকে অগ্রসর হয়। ওই দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পল্টন এলাকা লগি-বৈঠাধারীদের সন্ত্রাসী তান্ডবে এক রক্তাক্ত প্রান্তরে পরিণত হয়। মানুষ হত্যা করে মৃতদেহের ওপর নৃত্য করে বর্বর আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে আওয়ামী নেতাকর্মীরা। ২০০৬ সালের সেই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ দেশে সন্ত্রাসী রাজনীতির সূচনা করে, যা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তখন থেকেই দেশকে রাজনীতিশূন্য করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, বাকস্বাধীনতা ও ভোটাধিকারসহ জনগণের সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।

যেভাবে শুরু হয় লগি-বৈঠার তাণ্ডব:

২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রেডিও-টিভিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। মূলত এ ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই দেশব্যাপী শুরু হয় লগি-বৈঠার তাণ্ডব। বিভিন্ন স্থানে বিএনপি-জামায়াত অফিসসহ নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি যেমন চালানো হয় পৈশাচিক হামলা, তেমনি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় অনেক অফিস, বাড়িঘর, পুরো দেশব্যাপী চলে তাণ্ডবতা। চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছর পূর্তি উপললক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর উদ্যোগে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিকাল ৩টায় বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশ ছিল। সকাল থেকেই সভার মঞ্চ তৈরির কাজ চলছিল। হঠাৎ করেই সকাল ১১টার দিকে আওয়ামী লীগের লগি, বৈঠা ও অস্ত্রধারীরা জামায়াতের সমাবেশ স্থলে হামলা চালায়। দফায় দফায় হামলা চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত। সভার শেষ দিকে মাওলানা নিজামীর বক্তব্য শুরু হলে তারা তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পুনরায় হামলা চালায়। সেদিন পুরো পল্টন জুড়ে ছিল লগি, বৈঠা বাহিনীর তাণ্ডবতা। লগি-বৈঠার তাণ্ডব চালিয়ে তারা ছয়জনকে হত্যা করে এবং ওই তান্ডবে আহত হন সহস্রাধিক। এমনকি, মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তারা তার লাশের উপর ওঠে নৃত্য-উল্লাস করতে থাকে।

লাশ নিয়ে রাজনীতি:

সেদিন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জামায়াত কর্মী হাবিবুর রহমানকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, গুম করার জন্য লাশটি টেনে হিঁচড়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। পরে লাশটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেও চলতে থাকে আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিম বাহিনীর লাশ দখলের খেলা। তারা নকল বাবা মা সাজিয়ে নিয়ে যেতে চায় লাশটি। কিন্তু এ কারসাজি ধরা পড়ায় নকল বাবা মা সটকে পড়লে আওয়ামী লীগ হাবিবুর রহমানকে নিজেদের কর্মী দাবি করে তার লাশের ছবি ব্যবহার করে পোস্টারও ছেপেছিল।

সেদিন পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকা:

ঘটনার শুরু থেকেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ছিল নানান অভিযোগ। পুলিশের উপস্থিতিতেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জামায়াতের সমাবেশ স্থলে হামলা চালায়। এ সময় পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। অসহায় জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীদের শত অনুরোধেও পুলিশকে কোন ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি।

বেগম খালেদা জিয়ার উদ্যোগ:

জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ শেষ হওয়ার পরও আক্রমণ চলতে থাকে আওয়ামী লীগের। একটা পর্যায়ে দলটির শত শত নেতাকর্মী অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সন্ধ্যার পর আক্রমণের ভয়াবহতা বাড়ার আশংকায় শংকিত হয়ে ওঠেন তারা। এরপর জামায়াত নেতারা বাধ্য হয়েই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ সময় খালেদা জিয়া ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হয়েই তৎকালীন বিডিআরকে ঘটনাস্থলে আসার কথা বলেন। বিডিআর ঘটনাস্থলে আসার পরই পরিস্থিতি শান্ত হয়।

অধিকতর তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ:

এ ঘটনার পরদিন জামায়াতে ইসলামীর পল্টন থানার তৎকালীন আমীর এ.টি.এম সিরাজুল হক বাদী হয়ে পল্টন থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের ৪০ জন নেতার নামসহ সহস্রাধিক ব্যক্তিকে আসামী করা হয়। ২০০৭ সালের ১১ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে পলাতক আসামী হিসেবে উল্লেখ করে ৪৬ জন আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দাখিল করা হয়। চার্জশীট দাখিলের পর ২২ এপ্রিল ২০০৭ মামলার চার্জশীট গ্রহণ করেন মহানগর হাকিম মীর আলী রেজা। চার্জশীট গ্রহণ করেই আদালত পলাতক আসামী শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে। পরদিন ২৩ এপ্রিল তদন্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে পরোয়ানা স্থগিত করে মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন মহানগর হাকিম মীর আলী রেজা। তারপর অধিকতর তদন্তের নামে পার হয় তিন বছর।

পুরো মামলাই প্রত্যাহার:

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তাদের দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক ও শুভাকাংখীদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ৯ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আবু সাঈদ জনস্বার্থে পল্টন থানায় দায়ের করা হত্যা মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসককে একটি পত্র দেয়। ১৭ আগস্ট আদালত মামলাটি প্রত্যাহারের আবেদন মঞ্জুর করে।

২৮ অক্টোবর উপলক্ষ্যে কর্মসূচি ঘোষণা:

এদিকে, ২৮ অক্টোবর উপলক্ষ্যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এর মধ্যে রয়েছে মহানগরী, জেলা, উপজেলা ও থানা পর্যায়ে সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল, সকল পর্যায়ে আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠান। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে নেতাকর্মীদের বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হয়েছে। আজ মঙ্গলবার এসব কর্মসূচি পালন করার কথা রয়েছে দলটির।

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর