চট্টগ্রাম ব্যুরো: শেখ হাসিনার আমলে বন্দর ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল জানিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ শাহআলম বলেছেন, হাসিনার ধারাবাহিকতায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার সেটা আবার দিতে চাচ্ছে।
শনিবার (৮ নভেম্বর) বিকেলে নগরীর পুরাতন রেলস্টেশন চত্বরে বামগণতান্ত্রিক জোট ও ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা চট্টগ্রাম জেলা আয়োজিত গণসমাবেশে তিনি একথা বলেন। লাভজনক চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত বন্ধ করার দাবিতে এ গণসমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সিপিবির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ শাহআলম বলেন, ‘হাসিনার সব হারাম, চট্টগ্রাম বন্দর দেওয়ার সময় সেটা হালাল? আরগুলো সব হারাম? এই তো চলছে। তাহলে শাসকশ্রেণির স্বার্থ বুঝতে হবে। এই যে দেশবিরোধী, সার্বভৌমত্ববিরোধী যে চক্রান্ত চলছে, এর বিরুদ্ধে আজকে বন্দর শ্রমিক, বামপন্থীরা, চট্টগ্রামবাসী, গোটা বাংলাদেশ মিলে এটাকে প্রতিরোধ করতে হবে।’
সমাবশে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষা করা শুধু চট্টগ্রামবাসীর দায়িত্ব নয়, দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। আমাদের সবার আহার এই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ঢোকে আবার চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই বের হয়। এই বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) কি লস করছে না-কি লাভ করছে? গত একবছরে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল এক হাজার কোটি টাকার ওপরে লাভ করেছে। এখানে নতুন কিছু আধুনিক বসানোর আর স্কোপ নেই। ১২টা ক্রেনের জায়গায় ১৪টি ক্রেন চলছে। আর এই কনটেইনার টার্মিনাল দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে, একটা ইন্টারন্যাশনালি ফ্রড কোম্পানি। তার ভূমিকা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ, অথচ সেই কোম্পানিকে এটা দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।’
শেখ হাসিনার আমলে চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের কাছে দেওয়ার চক্রান্ত আরও একবার প্রতিহত করার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আগেও হাসিনার আমলে চট্টগ্রাম বন্দরকে আমেরিকান এসএসএ পোর্টের কাছে ১৯৮ বছরের জন্য লিজ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। আমরা তখন তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ব্যানারে রোডমার্চ করেছি, লংমার্চ করেছি। আরেকদিকে বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, আমি মোহাম্মদ শাহআলম আর বন্দরের আমাদের শ্রমিক নেতা নজরুল ভাই এবং সুনীল আইচ- আমরা চারজন হাইকোর্টে মামলা করেছিলাম। সেই মামলায় আমরা জিতেছি, এসএসএ কোম্পানির বিরুদ্ধে আমরা জিতেছি। তারপর এই বন্দর রক্ষা হয়েছে।’
চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষায় জামায়াতে ইসলামী-এনসিপির ভূমিকা কী?- এই প্রশ্ন তুলে শাহআলম বলেন, ‘আরেকটা বিষয় জানতে চাই, বন্দর বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্য কী? আমাদের প্রশ্ন। আপনি বলছেন হাংকি পাংকি চলবে না, আপনি নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার হাংকি পাংকি চলবে না- এটা বলছেন না কেন ? ওইটা বলেন, জামায়াত-এনসিপি যারা আজ টেলিভিশন ফাটায়ে ফেলতেছেন, আপনারা আপনাদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল সম্পর্কে আপনাদের বক্তব্য কি, পজিশন কি এটা পরিষ্কার করেন।’

বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র করার চক্রান্ত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তিনটা জিনিস- ডিপি ওয়ার্ল্ডকে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল দেওয়া, স্টারলিংককে অলরেডি দিয়ে দিয়েছে আর আরাকানে করিডোর- এগুলো একটা আরেকটার সাথে সম্পর্কিত। আজ গোটা বাংলাদেশ নিয়ে চক্রান্ত হচ্ছে। আরাকানে করিডোর দিলে ওখানে চীন-মায়ানমার বম্বিং শুরু করবে। সেখানে রোহিঙ্গা আর আরাকান আর্মি গিনিপিগ হয়ে যাবে। আমাদের দেশ যদি সেখানে ঢোকে, তাহলে আমাদের দেশ ফেইলড স্টেট হয়ে যাবে। ইউনূস সরকার আমাদের দেশকে ফেইলড স্টেটের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য চক্রান্ত করছে।’
‘যদি-ও আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী এই করিডোর দেওয়ার বিরুদ্ধে, অতিসত্ত্বর একটা নির্বাচন দিয়ে ইউনূস সরকার তুমি যাও- একথা তারা বারবার বলছে। তারা ডিপি ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধেও বলেছিল, যদিও এখন তারা বলছে না। সেনাবাহিনীকে এখন একটু চুপ দেখছি আমরা, কিন্তু তারা প্রথমে বলেছিল।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করছে উল্লেখ করে প্রবীণ এই বামনেতা বলেন, ‘আমরা এখন পাকিস্তান আমলের চেয়েও খারাপ অবস্থানে আছি। পাকিস্তান আমলেও আমাদের রাজনীতির মধ্যে আমেরিকানরা এত প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আমেরিকানরা আমাদের রাজনীতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে গেছে। এই আমেরিকা, এই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, তারা গাজার মধ্যে হাজার হাজার মানুষ মেরে মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে, ইসরাইলের তাঁবেদার এই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে আমাদের হুঁশিয়ার থাকতে হবে। পাকিস্তান আমলেও আমরা লড়াই করেছি, এখনও আমরা লড়াই করব। আসেন, আমরা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলি, আমরা চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষা করব, আমরা দেশকে রক্ষা করব।’
সমাবেশ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষায় আগামীকাল (রোববার) থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত ১৫ দিনব্যাপী সারাদেশে সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগের মধ্য দিয়ে জনমত সংগঠিত করা কর্মসূচি ঘোষণা করেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ।
তিনি বলেন, ‘এর মধ্যেও সরকার যদি তার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে না আসে, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমরা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যমুনা ঘেরাও কর্মসূচি দেব। সেই কর্মসূচি সফল করার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের অধিকার, আমাদের দাবি বাস্তবায়ন করব। তাতেও যদি সফল না হয়, এই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আমরা যেটা চাই না সেটাও করতে বাধ্য হব। হরতাল-অবরোধসহ কঠোর কর্মসূচি দিয়ে আমাদের বন্দর আমরা রক্ষা করব। রক্ত দিয়ে হলেও সেই সংগ্রামে সকলকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাই।’
বাম গণতান্ত্রিক জোট ও বাসদ(মার্কসবাদী) চট্টগ্রাম জেলার সমন্বয়ক শফি উদ্দিন কবির আবিদের সভাপতিত্বে ও জেলা সিপিবির সহ সাধারণ সম্পাদক নুরুচ্ছাফা ভূঁইয়ার সঞ্চালনায় গণসমাবেশে আরও বক্তব্য দেন- বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ, বাসদ(মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মাসুদ রানা, গণমুক্তি ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় আহবায়ক নাসিরউদ্দিন নাসু, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাংলাদেশ সোশ্যালিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম, বাসদ (মাহবুব) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আয়ুব রানা।
এছাড়া সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) ভারপ্রাপ্ত জেলা সমন্বয়কারী ও চট্টগ্রাম বন্দর সিবিএর সাবেক সাধারণ স্পাদক শেখ নুরুল্লাহ বাহার, জেলা সিপিবির সভাপতি অশোক সাহা, জেলা গণমুক্তি ইউনিয়নের সভাপতি রাজা মিঞা, বাসদের জেলা ইনচার্জ আল কাদেরি জয় এবং জেলা সাম্যবাদী আন্দোলনের সমন্বয়ক শাহীন মঞ্জুর।