ঢাকা: বাংলাদেশে ওষুধ শিল্প এখন স্থানীয় বাজারের প্রায় পুরো চাহিদা পূরণে সক্ষম। তবে ওষুধ তৈরির মূল কাঁচামাল অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) এর বড় অংশই আমদানি করতে হয় বিদেশ থেকে। এতে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা দেখা দিলে স্থানীয় উৎপাদনও ঝুঁকিতে পড়ে। এই বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে এসে স্থানীয়ভাবে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন বাড়াতে নীতি সহায়তা ও প্রতিবন্ধকতা নিরসনের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সেইসঙ্গে এপিআই শিল্পের উন্নয়নে একটি স্থায়ী টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
বুধবার (১২ নভেম্বর) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের অডিটোরিয়ামে অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ (এএইচআরবি) আয়োজনে ‘এপিআই শিল্পের উন্নয়নে নীতি ও বাস্তবায়ন কৌশল’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এসব মতামত তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও এএইচআরবি এর আহ্বায়ক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল উৎপাদন বাড়লে ওষুধ সরবরাহব্যবস্থা আরও স্থিতিশীল হবে, উৎপাদন ব্যয় কমবে এবং দাম সাধারণ মানুষের নাগালে থাকবে। এপিআই শিল্পে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা, স্বল্পসুদের ঋণ ও ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালুর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
তিনি বলেন, ভারত ও চীনের মতো বাংলাদেশেও এই খাতে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি গবেষণা ও উদ্ভাবন উৎসাহিত করতে গবেষণা অনুদান এবং আন্তর্জাতিক মান রক্ষায় কমপ্লায়েন্স গ্রান্ট চালুরও সুপারিশ করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর ওষুধ শিল্পে প্রতিযোগিতা বাড়বে। সেই পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে হলে স্থানীয়ভাবে এপিআই উৎপাদনের বিকল্প নেই। সরকারি–বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া গেলে বাংলাদেশ অল্প সময়ের মধ্যেই ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে আত্মনির্ভর হতে পারবে।
সভায় বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির (বাপি) মহাসচিব ডা. মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘এপিআই শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে বাস্তবসম্মত নীতিগত সহায়তা দিতে হবে, শুধু কমিটি গঠন করে হবে না। গত দেড় মাসে সরকারের যত কমিটি হয়েছে, সেখানে বাপি বা এপিআই শিল্পের কোনো প্রতিনিধিত্বই রাখা হয়নি। অথচ এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মতামত অপরিহার্য।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে এপিআইয়ের কাঁচামাল এখনো চীন ও ভারত থেকে আসে। কিন্তু সেখানে এমন দামের মেটারিয়াল আনা সম্ভব নয়, যাতে আমরা তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারি। সরকার যদি নীতিগতভাবে সাপোর্ট না দেয়, তাহলে এ শিল্প কখনোই টেকসই হবে না।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘এপিআই পার্কে জমির দাম আমরা পরিশোধ করেছি, কিন্তু সেই টাকার কোনো রিটার্ন পাচ্ছি না। ২০১৮ সালে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হলেও বলা হচ্ছে ২০২৫ সালে বিদ্যুৎ সংযোগ আসবে। সরকারের পক্ষ থেকে জমির দাম ও ইন্টারেস্ট নেওয়া হলেও অবকাঠামোগত সুবিধা এখনো অনিশ্চিত। এপিআই শিল্প পার্কে স্টেকহোল্ডারদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। যারা কমিটিতে আছেন, তারা কি কখনো আমাদের ব্যথা বুঝবেন? প্রশাসনিক জটিলতা মেটাতে হবে, না হলে প্লট হস্তান্তর, প্লট বিনিময় বা নেশাজাতীয় পদার্থের অনুমোদন–সব জায়গায় সময়ের অপচয়ই হবে।’
সভায় বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির কোষাধ্যক্ষ মুহাম্মদ হালিমুজ্জামান বলেন, ‘সরকারের উৎসাহে ৪৯০ কোটি টাকা লোন নিয়ে ২ বছর আগে এপিআই পার্কে কারখানা স্থাপন করছি। এখন প্রতিদিন ২০ লাখ টাকা সুষ দিতে হচ্ছে। তবে এখন সরকার থেকে বলছে গ্যাস পাওয়া যাবে না। এই অবস্থায় আমার পর আর কোনো পাগল এখানে আসবে এপিআই পার্ক করতে।’
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন সদস্য ও বিজ্ঞানী আইসিডিডিআরবি ড. আহমেদ এহসানুর রহমান বলেন, ‘এপিআই শিল্পের ৯০ ভাগ সমস্যা কথা আমার জানি। গত এক যুগ থেকে এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তবে উত্তরণ হচ্ছে না। আগে এপিআই নিয়ে সরকার ও কোম্পানিগুলোর দর্শন ঠিক করতে হবে।’