ঢাকা: জুলাই সনদ ও গণভোট নিয়ে দলগুলোর আন্দোলনের মধ্যেই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভাষণে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল সংস্কার। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও গণভোটই হলো সংস্কারের মূল প্রতিপাদ্য। যা নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে চলছে ঠাণ্ডা লড়াই। দুই দলকে সন্তুষ্ট করতে প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে যে ঘোষণা দিলেন তাতে কোন দল বা জোট বেশি লাভবান হলো তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলসহ সর্বক্ষেত্রে চলছে চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ।
বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) দুপুরে জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষনের পরপরই বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ সকল রাজনৈতিক দল তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। আবার সামাজাকি যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া। সবকিছুর মূলে যে আলোচনা সেটা হলো প্রধান উপদেষ্টা যে ঘোষণা দিলেন তাতে কোন দল বেশি লাভবান হলো।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ দুপুরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সমালোচনা করলেও রাতে জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর দলীয়ভাবে প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বিএনপি। জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া ভাষণে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ও গণভোটের ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করায় প্রধান উপদেষ্টাকে বিএনপির স্থায়ী কমিটি ধন্যবাদ জানিয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ আটটি দলের পক্ষ থেকে দুই ধরনের মন্তব্য করা হয়েছে। তারা প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের একাংশকে (জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির আদেশ জারি) মেনে নিয়ে ধন্যবাদ জানালেও অপর অংশের জন্য তারা নাখোশ। তারা বলেছেন, একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট গ্রহণযোগ্য নয়। এ ঘোষণায় জাতি হতাশ হয়েছে। একইসঙ্গে তারা আলাদা দিনে গণভোট করার জন্য প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহবান জানান।
এর বাইরে এনসিপি বলেছে, সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির মাধ্যমে সরকার সব রাজনৈতিক দলকে আপাতদৃষ্টিতে খুশি করলেও বাস্তবে দেশের বৃহত্তর জনগণকে ফাঁকি দিয়েছে। এই আদেশের মাধ্যমে মৌলিক সংস্কারের দিকে যাওয়া যাবে না। বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় দলের অস্থায়ী কার্যালয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা বলেন দলটির নেতারা। এ সময় নেতারা বলেন, বাহাত্তরের ফ্যাসিবাদী কাঠামো দূর করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই আদেশের মধ্যে দিয়ে আমরা বাহাত্তরের সংবিধানের পথেই হাঁটছি। এক হাসিনা যাওয়ার পর আরেক হাসিনা আসার প্রস্তুতি চলছে।
এদিকে জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে জাতির সঙ্গে প্রতারণা বলে আখ্যা দিয়েছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা। এই ভাষণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ বাড়িয়ে দেশকে দীর্ঘস্থায়ী সংকটে ঠেলে দেবে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা। এক বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘বিএনপি, জামায়াত, এনসিপির (জাতীয় নাগরিক পার্টি) একমত হওয়াকেই যদি সবার ঐক্যমত বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে তা এতদিন ধরে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠককেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।’
এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল মনে করছে, সরকার সবদলকে সন্তুষ্ট করার জন্য এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একদিকে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে দেওয়ায় বিএনপি খুশি। তারা সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। অপরদিকে জুলাই আদেশ জারি, উচ্চকক্ষে পিআর মেনে নেওয়ায় জামায়াতসহ সমমনারা খুশি। আবার বিভিন্ন সংস্কার প্রশ্নে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট গ্রহণ না করে তা গণভোটে দেওয়ায় এনসিপিও অনেকাংশে খুশি। তার মানে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে সবদলেরই কিছু না কিছু দাবি মানা হয়েছে। এখন দলগুলো দাবি-দাওয়া ছেড়ে নির্বাচনি মাঠে সক্রিয় হলেই দেশ একটা স্বস্তির দিকে যাবে।
আবার কেউ কেউ বলছেন, জামায়াতসহ আট দল তাদের দাবির একাংশ জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট এবং নিম্নকক্ষে পিআর নিয়ে আন্দোলনে থাকে তাহলে দেশ সংঘাতের দিকে যাবে। একটি পক্ষ মনে করছে, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় বিএনপির জয় হয়েছে। তাদের মতে, বিএনপির দাবি মেনে নিয়েই প্রধান উপদেষ্টা একই দিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। বিএনপির পক্ষের একভিস্টদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লেখালেখিতেও তেমনটি মনে হচ্ছে। তাদের বক্তব্যে বোঝা যায়, জামায়াত এ পর্যায়ে হেরে গেছে। তাদের মতে, জামায়াতের কোনো দাবি মানা হয়নি।
অপরদিকে জামায়াতের পক্ষের বিশ্লেষকদের ভাষ্যমতে, জামায়াতসহ আট দলের দাবি ছিল আগে গণভোট ও পরে জাতীয় নির্বাচন। সাথে পিআর পদ্ধতিতে উভয় কক্ষে নির্বাচন। এ দাবি তাদের আদায় হয়নি। কিন্তু উচ্চ কক্ষে পিআর মেনে নিয়েছে। এই উচ্চ কক্ষে পিআর মেনে নেওয়া এবং সংসদের যেকোনো আইন পাস করতে হলে উচ্চ কক্ষের অনুমোদন। এই দুটি জায়গায় জামায়াতসহ তার সঙ্গী দলগুলোর বিজয় হয়েছে। কারণ, বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পাবে না। সেক্ষেত্রে নিম্নকক্ষে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও পিআর পদ্ধতির কারণে উচ্চকক্ষে বিরোধী দলের সদস্য বেশি থাকবে। ফলে বিএনপি তাদের ইচ্ছে মতো কোনো আইন পাস করতে পারবে না।
এছাড়া, জামায়াতের পক্ষের বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। এ বিষয়ে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিলেও সেটা গণভোটে দেওয়া হয়েছে। গণভোটে হ্যাঁ জয়যুক্ত হলে সেখানেও বিএনপির পরাজয় হবে। উচ্চ কক্ষে পিআর এর বিরুদ্ধেও বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিল। সেখানেও তারা হেরে যাবে যদি হ্যাঁ ভোট জয়ী হয়। এছাড়াও দলীয় প্রভাবমুক্ত পিএসসি, দুদক চেয়ারম্যান নিয়োগ পদ্ধতি, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ, অডিটর জেনারেল নিয়োগ, সবচেয়ে সিনিয়র বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি নিয়েও নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিল বিএনপি। এখন বিএনপির এসব নোট অব ডিসেন্ট গণভোটে দেওয়া হয়েছে। আর গণভোটে যদি হ্যাঁ জয়ী হয়ে যায় তাহলে বিএনপির আপত্তিগুলো টিকবে না। সব মিলিয়ে জামায়াতসহ তাদের সঙ্গীরা প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় বেশি লাভবান হয়েছে বলে মনে করছেন তাদের সমর্থকরা।
বিএনপি চেয়ারপাসরনের উপদেষ্টা বিশিষ্ট আইনজীবী মাসুদ আহম্মেদ তালুকদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। এতদিন যারা অযৌক্তিক দাবি তুলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চেয়েছিল তাদের চৈতন্যের উদয় হবে। এখানে লাভ-ক্ষতির কোনো বিষয় নয়। সরকার যে ঘোষণা দিয়েছে, সেই ঘোষণার প্রতি আস্থা রেখে সবদলকে নির্বাচনমুখী হওয়া উচিত। নির্বাচন ছাড়া দেশে শান্তি ফিরে আসবে না। সেজন্য জরুরি ভিত্তিতে একটি নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন।’
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় কে কতটা লাভ-ক্ষতিতে পড়েছে তা বলতে চাই না। তবে আমাদের যে পাঁচ দফা দাবি ছিল তা এখনো আছে। তার মধ্যে জুলাই সনদ জারি হয়েছে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট দেওয়ার দাবি এখনো বহাল রয়েছে।’