ব্রাহ্মণবাড়িয়া: ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসন দেশের পূর্ব সীমান্তবর্তী একটি কৌশলগত আসন, যেখানে দুটি পৌরসভা, ১৫টি ইউনিয়ন এবং তিন শতাধিক গ্রামের প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ ভোট দেন। এই গুরুত্বপূর্ণ আসনে বিএনপি এখন এক নজিরবিহীন মনোনয়ন সংকটে পড়েছে। দীর্ঘ ১৭ বছর এলাকার বাইরে থাকা, প্রায় ৯০ বছর বয়সী এবং দৃশ্যত অতি বয়োবূদ্ধ একজন ব্যক্তিকে প্রার্থী ঘোষণা করায় স্থানীয় রাজনীতিতে বিস্ময় হতাশা ও তৃণমূল থেকে শুরু করে সাধারণ ভোটারদেরন মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
আসনটিতে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তিনি হলেন— সাবেক সংসদ সদস্য ও আমলা মুশফিকুর রহমান।
এলাকার সাধারণ মানুষের ক্ষোভ প্রধানত তার বয়স নিয়ে। তাদের ভাষ্য, ৯০ বছর বয়সী এই নেতা ঠিকভাবে দাঁড়াতে পারেন না; নিজে হাঁটতেও অন্যের সহায়তা নেন। এমনকি প্রাথমিক প্রচারণাতেই দলকে অ্যাম্বুলেন্স ও মেডিকেল টিম বহন করতে হচ্ছে। এমন বয়োবূদ্ধ একজন প্রার্থী কিভাবে সাড়ে চার লাখ ভোটারের দায়িত্ব পালন করবেন? জনমতের ভাষায় এটি যেন “জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রহসন” একটি বৃহৎ আসনকে এমন একজন প্রার্থীর হাতে সঁপে দেওয়ার মতোই।
এই অবস্থায় তৃণমূলে আরও ক্ষোভ জন্মেছে কারণ গত দেড়–দুই দশক ধরে কসবা–আখাউড়ায় সাংগঠনিক নেতৃত্ব দিয়েছেন আলহাজ্ব কবীর আহমেদ ভূঁইয়া। দমন–পীড়ন, গুম–হত্যা আর হাজারো মামলার মধ্যেও যিনি সংগঠন টিকিয়ে রেখেছেন, সাম্প্রতিক গণসমাবেশে যার সমর্থনে লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল, সেই নেতাকে উপেক্ষা করে দীর্ঘদিন কসবা আখাউড়া র রাজনীতির মাঠে অনুপস্থিত থাকা এমন একজন ব্যক্তিকে প্রার্থী করায় তৃণমূল বিষয়টিকে সরাসরি কেন্দ্রীয় সিন্ডিকেটের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখছে।

আলহাজ্ব কবীর আহমেদ ভূঁইয়া।
তৃণমূলের বক্তব্য, তাদের মতামত উপেক্ষা করে মনোনয়ন বাণিজ্যের ছাপ রেখে প্রার্থীর পক্ষে গোয়েন্দা রিপোর্ট পর্যন্ত বিকৃত করা হয়েছে। বহু অভিযোগে উঠে এসেছে— অচল প্রার্থীকে তুলে ধরার জন্য দলের ভেতরে অস্বচ্ছ রাজনৈতিক লেনদেন হয়েছে, যা স্থানীয়দের মধ্যে সন্দেহ ও ক্ষোভ আরও গভীর করেছে।
সমস্যা এখানেই শেষ নয়। মুশফিকুর রহমানকে ঘিরে অতীতের বিতর্ক– ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী কানাডা প্রবাস জীবন, ‘দেশ টিভি’ নিয়ে আওয়ামীলীগপন্থী মহলের সঙ্গে সম্পর্ক, এবং এলাকায় দীর্ঘ অনুপস্থিতি— এসব কারণে তৃণমূলের চোখে তিনি একধরনের রাজনৈতিক সুবিধাবাদী ব্যক্তি।
অনেক নেতাকর্মীর দাবি, তিনি অতীতে বিএনপি কর্মীদের সংগঠন ছাড়ার পরামর্শও দিতেন। ফলে তার মনোনয়ন এলাকায় নতুন নয়, বরং পুরনো ক্ষতকে আরও তীব্র করেছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিশ্লেষণটি এসেছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছ থেকে। তাদের বক্তব্য, শারীরিকভাবে অক্ষম এরকম একজন প্রার্থী থাকলে বিএনপির ভোট স্বাভাবিকভাবেই ভেঙে যাবে এবং সরাসরি লাভবান হবে জামায়াত। ইতোমধ্যে জামায়াতপন্থী মহলে এই প্রার্থীকে নিয়ে ট্রল চলছে, যা স্পষ্ট করে দেয়, ভোটের মাঠে বিএনপি ব্যাকফুটে পড়বে।
অন্যদিকে সাধারণ ভোটারদেরও বড় উদ্বেগ— যিনি প্রচারণামঞ্চে দাঁড়াতে পারেন না, তিনি নির্বাচিত হলে এলাকায় সেবা দেবেন কীভাবে? ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার পর লোকজন এবার প্রতীকের পাশাপাশি প্রার্থীকে সমান গুরুত্ব দেবে— এমন বাস্তবতায় বিএনপি যদি অচল প্রার্থীকে রেখে দেয়, আসনটি হারানো ছাড়া আর কোনো ফলাফল হাতে থাকবে না।
সব দিক বিবেচনায় তৃণমূলের দাবি এখন একটাই— সিন্ডিকেটের ভূমিকা তদন্ত করে, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য, ত্যাগী, মাঠে-পরীক্ষিত নেতা আলহাজ্ব কবীর আহমেদ ভূঁইয়াকে মনোনয়ন দেওয়া। এটি না হলে বিএনপি শুধু একটি কৌশলগত আসন নয়, বরং সমর্থকদের আস্থা হারানোর ঝুঁকিতেও পড়বে। কসবা–আখাউড়ার রাজনৈতিক বাস্তবতা এখন সেই সতর্কবার্তাই উচ্চারণ করছে।