Saturday 22 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

একজন রেনু মিয়া, বই আর ট্রেনই যার জীবন

জুলফিকার তাজুল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২২ নভেম্বর ২০২৫ ০৭:৫৯

জীবন সংগ্রামী রেনু মিয়া। ছবি: সংগৃহীত

সিলেট: রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে প্রতিদিন দেখা মেলে এক মানুষের। বয়স ৭০ ছুঁইছুঁই, চেহারায় বয়সের রেখা, কিন্তু চোখে এখনো একরাশ জীবনের আলো। কাঁধে একটা পুরনো ব্যাগ, তার ভেতরে টাইগার বাম, দাঁতের মাজন, আদা মিষ্টি, ছোট ছোট গল্পের বই, নামাজ শিক্ষা, দোয়ার বই, এমনকি বাচ্চাদের অক্ষর শেখার খাতা, সবকিছুই তার সংসারের ইতিহাসের অংশ। হরেকরকম জিনিস ফেরি করা এই মানুষটির নাম— মো. রেনু মিয়া।

রেনু মিয়ার বাড়ি হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার শিবপুর গ্রামে। ১৯৯৭ সালে এক মামলায় পড়ে গ্রাম ছাড়েন। তারপর চলে আসেন সিলেটে। তখন জীবন বড় অনিশ্চিত। হাতে কোনো পুঁজি নাই, কিন্তু বাঁচার ইচ্ছে প্রবল। তাই ট্রেনে ফেরি করে বই বিক্রি শুরু করেন। দিনভর ট্রেনে ঘুরে গল্প, ছড়া, হাদিস, দোয়ার বই বিক্রি করতেন। বিকেলে ক্লান্ত শরীরে ফিরতেন রেলস্টেশনে। তারপরও মুখে থাকত তৃপ্তির হাসি।

বিজ্ঞাপন

সেই সময় তার মুখে হাসির কারণও ছিল— বিক্রি ভালো হতো। দিনে ৬-৭ হাজার টাকার মতো বই বিক্রি করে সংসার চালাতেন। সেই টাকায় গড়ে তোলেন নিজের ছোট্ট দালান ঘর, বড় করেন পাঁচ মেয়ে আর এক ছেলেকে। ‘তখন মানুষ বই পড়তো, বইয়ের দাম দিত, গল্প শুনতে ভালোবাসত’— স্মৃতিতে হারিয়ে যান রেনু মিয়া।

কিন্তু এখন সময় পাল্টে গেছে। ট্রেনের যাত্রী আছে, কিন্তু পাঠক নেই। কেউ ফোনে ডুবে থাকে, কেউ ভিডিও দেখে। রেনু মিয়া বলেন, ‘মানুষের হাতে পয়সা নাই, মনেও আগ্রহ নাই। বই বিক্রি হয় না এখন। দিনে বহু কষ্টে একশ টাকা রোজগার করি।’

তবু তিনি থামেননি। প্রতিদিন সকালে ব্যাগে বই আর বাম নিয়ে স্টেশনে আসেন। সূর্য ওঠা থেকে শেষ ট্রেন ছাড়ার আগ পর্যন্ত ঘুরে বেড়ান। কখনো প্ল্যাটফর্মে, কখনো কামরার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, আবার কখনো ট্রেনের ভেতরে। বই বিক্রি না হোক, তারপরও মানুষকে বই হাতে তুলে দেওয়ার আনন্দটুকুই যেন তার জীবনের শেষ স্বপ্ন।

রেলস্টেশনের অনেকেই তাকে চেনেন, স্নেহভরে ডাকেন ‘রেনু ভাই’। কেউ কেউ পুরনো যাত্রী হয়ে ফিরে এসে হাসিমুখে বলেন, ‘আপনার কাছ থেকে বই নিয়েছিলাম, এখনো রেখে দিয়েছে।’ এমন স্মৃতিই তার প্রেরণা। বয়সের ভারে এখন হাঁটতে কষ্ট হয়, তবু বলেন, ‘যতদিন শরীরে শক্তি আছে, বই বিক্রি করব। এই বই, এই ট্রেন—এই আমার জীবন।’

রেললাইনের ধারে, শহরের কোলাহলের মাঝেও রেনু মিয়া এক নীরব প্রতীক, একজন মানুষ- যিনি সময় বদলে যাওয়া ধারা সত্ত্বেও ভালোবাসেন জ্ঞান ও বই। আর বিশ্বাস করেন— একদিন হয়তো আবার মানুষ বইয়ের পাতায় ফিরবে।

সারাবাংলা/পিটিএম
বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর