ঢাকা: আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রাথমিক সম্ভাব্য মনোনয়ন ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের মাঠে নেমেছে বাংলাদেশের বৃহত্তম দল বিএনপি। যদিও সরকার ও নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ফেব্রুয়ারির সময় অনুযায়ী ভোটের বাকি এখনো তিন থেকে সাড়ে তিন মাস। কিন্তু মাঠ গোছাতে বিএনপি যতটা জনগণের কাছে যেতে চাচ্ছে, তার চেয়ে দ্রুত গতিতে বাড়ছে দলটির অভ্যন্তরীণ বিরোধ।
সম্ভাব্য প্রাথমিক মনোনয়ন তালিকা ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন জেলায় দেখা দিয়েছে অসন্তোষ, বিক্ষোভ, পালটা-পালটি কর্মসূচি এবং মহাসড়ক অবরোধের মতো ঘটনা। দলটি যেভাবে ‘ঐক্যের রাজনীতি’ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি নিয়ে নির্বাচনে যাচ্ছে, বাস্তবে ঠিক তার উলটো চিত্রই দেখা যাচ্ছে তৃণমূলে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই অস্থিরতা বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতাকে উন্মোচন করছে। আর ঠিক সেই জায়গায় ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো।
তৃণমূলে বিভাজন
বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া নেতারা ব্যয়বহুল প্রচার চালাচ্ছেন। অন্যদিকে যারা মনোনয়ন তালিকায় নেই, তারাও সম্ভাব্য পরিবর্তনের আশায় মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। এমনকি সমানভাবে অর্থ ব্যয় করে দলে বিভাজনের রেখা টেনে দিচ্ছেন তাদের কেউ কেউ। কোথাও কোথাও মনোনয়ন প্রাপ্ত ও বঞ্চিত পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে খোলামেলা বিরোধ তৈরি হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও বিরোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মহাসড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল, এমনকি দলীয় কার্যালয় ঘেরাওয়ের ঘটনাও ঘটেছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, “মনোনয়নকে কেন্দ্র করে পুরো সংগঠনের শক্তি যেখানে এক জায়গায় হওয়ার কথা ছিল, সেখানে ‘বিভক্তি’ তৈরি হয়েছে। এটি শুধু প্রচারকেই দুর্বল করছে না, বরং ভোটারদের কাছেও একটি নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে। এদিকে দলটির আরেকটু সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।”
হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য
দলীর মনোনয়ন ঘোষণার আগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। বৈঠকে বলা হয়, যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক না ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকতে হবে। যারা মনোনয়ন বঞ্চিত হবেন দল তাদের অন্যভাবে মূল্যায়ন করবে। হাইকমান্ড শুরু থেকেই সম্ভাব্য প্রার্থীদের ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকার নির্দেশ দিলেও মনোনয়ন ঘোষণার পর দেখা যাচ্ছে ভিন্ন রূপ। অনেক জায়গায় প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীরা বঞ্চিত নেতাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই করছেন না। আবার কোনো কোনো জায়গায় বঞ্চিত নেতারাই মনোনয়নপ্রাপ্তদের দেখা দিচ্ছেন না। ফলে দলীয় নির্দেশনা কার্যত অমান্য হচ্ছে, যা তৃণমূলে অস্থিরতা তৈরি করছে।
এসব বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যেসব আসনে দুই-তিনজন অত্যন্ত শক্তিশালী প্রার্থী আছে, সেখানে ঐক্য প্রতিষ্ঠা সবচেয়ে কঠিন। অনেকেই মনে করছেন মনোনয়ন এখনো পরিবর্তন হতে পারে। তাই কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছেন না।’
কিছু আসনে বিরোধ প্রকাশ্যে
বিএনপি ঘোষিত প্রাথমিক মনোনয়ন তালিকার মধ্যে অন্তত ৪০টি আসনে স্থানীয় পর্যায়ে তীব্র বিরোধ দেখা দিয়েছে। বঞ্চিত প্রার্থীদের অভিযোগ— জরিপে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে ও জনপ্রিয়তা যাচাইয়েও ত্রুটি রয়েছে। ফলে লবিং করে অনেকেই প্রাথমিক তালিকায় জায়গা পেয়েছেন। তাই তারা মাঠ ছাড়ছেন না। এদিকে প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া নেতারা নিজস্ব কর্মীবাহিনী নিয়ে মাঠ দখলে রাখার চেষ্টা করছেন। এতে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও বিক্ষোভ বা পালটা বিক্ষোভ হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রমিত আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ ধরনের বিরোধ নির্বাচনের মাঠে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। বিএনপির মধ্যে এই বিভাজন সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী দলের পাল্লা ভারী করবে। বিশেষ করে জামায়াতের প্রার্থী যদি এলাকায় শক্তিশালী হয়, তাহলে বিএনপির দ্বন্দ্ব নির্বাচনে ভোটারদের জামায়াতের দিকে ঠেলে দিতে পারে।’
বিরোধ মেটাতে রাত-দিন বৈঠক
গুলশান কার্যালয়ে প্রতিদিনই বিভিন্ন আসনের সম্ভাব্য ও বঞ্চিত প্রার্থীদের ডেকে বিরোধ মেটানোর চেষ্টা হচ্ছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘বার বারই বলা হয়েছে যে, এটা চূড়ান্ত তালিকা নয়, সম্ভাব্য তালিকা। যেখানেই পরিবর্তনের প্রয়োজন মনে হবে, দল সেটা করবে। অনেক এলাকায় দুই-তিনজন করে যোগ্য প্রার্থী আছেন, সেখানেই ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তবে সেগুলো মীমাংসার চেষ্টা চলছে। আশা করছি, আমাদের নেতাকর্মীরা সেগুলো বুঝতে পারবেন।’
দলের একটি মূল্যায়ন টিম আসনভিত্তিক শক্তি দুর্বলতা যাচাই করছে। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে তালিকা পুনর্মূল্যায়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। তৃণমূলের অনেকেই মনে করছেন, এই পুনর্মূল্যায়ন যতটা দ্রুত ও স্বচ্ছ হয়, তার ওপর বিএনপির নির্বাচনি মাঠে টিকে থাকার সক্ষমতা নির্ভর করছে।
সুযোগ নিচ্ছে জামায়াত-এনসিপি
বিএনপির অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সুযোগটি সবচেয়ে ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। বেশ কয়েকটি আসনে জামায়াত এরই মধ্যে ‘একক মাঠ’ তৈরি করে ফেলেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে; যেসব আসনে বিএনপি নিজেদের বিরোধেই জর্জরিত। মাঠ পর্যায়ের একাধিক নেতার মতে— বিএনপির ভোটাররা হতাশ। এছাড়া প্রার্থীদের প্রচারে বিভক্তি স্পষ্ট হচ্ছে। কারণ, সেখানে চলছে টাকার খেলা। আর এসব দেখে প্রকৃত কর্মীরা হতাশ ও নিরুৎসাহিত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে জামায়াত বিএনপির দোদুল্যমান ভোটগুলো নিজেদের বাক্সে টানার চেষ্টা করছে।
এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় জেলা বিএনপির এক নেতার সঙ্গে। নাম গোপন রাখার শর্তে ওই নেতা বলেন, ‘আমরা নিজেরা নিজেদের বিপক্ষে লড়ছি। এতে এলাকায় জম-জমাট প্রচার চালানো যাচ্ছে না। আর ঠিক সেই সুযোগে জামায়াত তাদের সংগঠন শক্ত করছে।’
অন্যদিকে মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থীদের কৌশলে দলে টানার চেষ্টা করছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। দলটির নেতারা অনেকবারই বলেছেন, ‘বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিতদের স্বাগতম।’ এ বিষয়ে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তরুণ নেতৃত্বকে বেশি গুরুত্ব দিই। সেদিক থেকে মনে হয়েছে, বিএনপি তরুণ নেতৃত্বদের হতাশ করেছে। সেক্ষেত্রে আমরা তাদেরকে স্বাগতম জানিয়েছি।’
সংকটে কেন্দ্র-তৃণমূল সম্পর্ক
বর্তমান সংকট কেবল দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যাই নয়, এটি স্থানীয় ভোটারদের মনেও বিভ্রান্তি তৈরি করছে। যে দলটি দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে এবং ‘পরিবর্তনের রাজনীতি’ সামনে এনেছে, সেই দলটি এখন নির্বাচনের মুখে এসে নিজেদের ভেতরেই ঐক্য ধরে রাখতে পারছে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রমিত আজাদ বলেন, ‘দলের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সাধারণ ভোটারের কাছে খুব স্পষ্ট বার্তা পাঠায়, দলটি এখনো সুসংগঠিত নয়। নির্বাচনের আগে এ ধরনের সংকট প্রতিপক্ষের জন্য বড় সুবিধা তৈরি করে।’
বিএনপির সামনে কঠিন সময়
নির্বাচনের আগে দলীয় ঐক্যই হওয়া উচিত ছিল বিএনপির সবচেয়ে বড় শক্তি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বিরোধ, বিক্ষোভ, দ্বন্দ্ব, অনিশ্চয়তা- এই চারটি ‘শব্দই’ এখন দলের মাঠপর্যায়ের রাজনীতিকে নির্দেশ করছে। ফলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, এই পরিস্থিতি যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না আসে, বিএনপির সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াবে বিএনপি নিজেই। আর ঠিক এই জায়গাতেই লাভ দেখছে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি।
যা বলছেন বিশ্লেষকরা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপিকে দ্রুত মনোনয়ন–সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হবে। সেইসঙ্গে প্রার্থী তালিকায় স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। এর বাইরে বঞ্চিত প্রার্থীদের দায়িত্ব ও ভূমিকা স্পষ্ট করতে হবে। যেসব আসনে ২-৩ জন সম্ভাব্য প্রার্থী রয়েছে সেখানে সমন্বয় কমিটি গঠন করে একজনকে দ্রুত চূড়ান্ত করতে হবে। হাইকমান্ডের সঙ্গে তৃণমূলের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এসব উদ্যোগ দ্রুতই নিতে হবে। তা না হলে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, বিরোধ ততই বাড়বে বলে তাদের আশঙ্কা।