Wednesday 03 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাজনীতিতে যেভাবে এগোলো জামায়াত

মো. মহসিন হোসেন স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ২৩:৪২

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ফাইল ছবি

ঢাকা: জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির দেশের চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয় পেয়েছে। তাদের এই সাফল্য জামায়াতকে অনেকটা আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। দলীয় নেতাকর্মীরা মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতও ভালো ফল করবে। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে তারা দেশব্যাপী ৩০০ আসনে আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে।

গতবছর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতনের চারদিন আগে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। ততদিনে গোপনে গোপনে বটগাছে পরিণত হয়েছে দলটি। তাই হয়তো নিষিদ্ধের নোটিশ দেখে তারা কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। সেই জামায়াত এখন আওয়ামী লীগের জায়গা দখল করতে চায়। এমনকি তারা নির্বাচনে বিএনপিকেও হার মানাতে চায়।

বিজ্ঞাপন

একসময় দেশের রাজনীতিতে দু’টি ধারা ছিল। একদিকে আওয়ামী লীগ, অপর দিকে বিএনপি। ১৯৯০ সালে এরশাদ পতনের পর এই দু’টি দলকে ঘিরেই চলেছে দেশের রাজনীতির চাকা। সেখানে এখন জামায়াত একটি নতুন শক্তিশালী বলয়ে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিএনপি-আওয়ামী লীগকেও ছাড়িয়ে যেতে চায় ধর্মভিত্তিক এই দলটি। তবে তাদের এই উত্থান একদিনে হয়নি, আর কাকতালীয়ভাবেও নয়।

একটি দল যাদের কার্যক্রম ছিল সরকারিভাবে নিষিদ্ধ, ছিল না নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন। শীর্ষ নেতাদের ঝোলানো হয় ফাঁসিতে। আর দ্বিতীয় সারির সবাই ছিলেন কারাগারে। দলটির মুক্তভাবে সভা-সমাবেশ করার অনুমতিও ছিল না। তাহলে তারা বর্তমানে কীভাবে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হলো। এ প্রশ্ন এখন রাজনৈতিক মহলে, আর চলছে আলোচনাও।

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যা পাওয়া যাচ্ছে, তা হলো তাদের কৌশল। নিষিদ্ধ অবস্থায় থেকে জামায়াতে ইসলামী সমাজের গভীরে প্রবেশ করেছে অনেকটা নীরবে-নিভৃতে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ, মাদরাসা, খানকা, সামাজিক সংগঠন, এমনকি তরুণদের মধ্যে তারা গড়ে তুলেছে এক আদর্শিক পরিমণ্ডল। তারা বুঝতে পেরেছে দেশের মূলধারার রাজনীতি যুগের পর যুগ মানুষকে হতাশ করেছে। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গই যেন এদেশের রাজনীতির কৌশল। এই হতাশার মধ্যেই মানুষ ধর্মে আশ্রয় খুঁজেছে। জামায়াত সেই শূন্যতাকে ব্যবহার করেছে সুক্ষ্মভাবে। সামাজিক সেবামূলক কার্যক্রম, অনলাইনে প্রচার, ইসলামপন্থী তরুণদের নেটওয়ার্ক। সর্বক্ষেত্রে তারা তৈরি করেছে রাজনীতির নতুন এক ইকো সিস্টেম। নিষিদ্ধ থাকার ফলে তারা বিরোধিতা ও সমালোচনার মুখোমুখি হয়নি। নিপীড়িত দল হিসেবে জনগণের সহানুভূতি অর্জন করেছে।

রাজনীতি সচেতন মানুষ মনে করে, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বিএনপি দীর্ঘদিন পর জনসমর্থনে শীর্ষে, অপরদিকে জামায়াত নীরব উত্থানে এগিয়ে। আর আওয়ামী লীগ তার ঐতিহাসিক অবস্থান থেকে বহুদূর পিছিয়ে গেছে। ফলে মুখোমুখি অবস্থানে বিএনপিকে পেছনে ফেলতে চায় জামায়াত। তারা কি পারবে বিএনপিকে পেছনে ফেলে ক্ষমতার মসনদ দখল করতে? কেউ কেউ বলছেন, না পারলেও কাছাকাছি যাবে- সেটা বলাই যায়। সাম্প্রতিক বিভিন্ন জরিপেও সেটা স্পষ্ট হচ্ছে।

৫ আগস্টের পর দেশের রাজনীতির ভূগোল অনেকটা বদলে গেছে বলে মনে করেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা। ধর্ম, তরুণদের আকাঙ্ক্ষা, সামাজিক ন্যায্যতা ও নৈতিকতার প্রশ্ন- সবমিলিয়ে নতুন এক রাজনীতির জন্ম নিচ্ছে। যা কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয়, বরং এক আদর্শগত স্রোতের পুনরুত্থানের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সেই আদর্শগত রাজনীতিতে অন্য যেকোনো দলের চেয়ে জামায়াত যে অনেকটা এগিয়ে আছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।

দীর্ঘ এক দশক পর ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়। তারপর থেকেই ৭১ এর স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াত সংসদীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নেয়। স্বাধীন দেশের মাটিতে মূলত ১৯৯১ সালের নির্বাচনেই প্রথম ১৭টি আসন নিয়ে সংসদে যায় জামায়াত। কিন্তু ৯৬ সালের নির্বাচনে ফের পিছিয়ে পড়ে। সেবার আসন পায় মাত্র তিনটি। ২০০১ সালে পুনরায় ১৮টি আসন নিয়ে ফিরে আসে। তারপর গত ২৪ বছরে সংসদে ও বাইরে তেমন সুবিধা করতে পারেনি ধর্মভিত্তিক এই দলটি।

কিন্তু ৫ আগস্টের পর পুনরায় উত্থান হয় তাদের। গত প্রায় দেড় বছরে কী পরিমাণ এগিয়ে গেছে তা তাদের নানান কর্মকাণ্ড দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এরই মধ্যে তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির দেশের সবচেয়ে বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করেছে। সেই ছাত্র নেতাদের এখন ট্রাম কার্ড হিসেবে ব্যবহার করছে জামায়াত। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বড় বড় জনসভায় ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েমের উপস্থিতি সেটাই জানান দিচ্ছে।

রাজনীতি সচেতনরা এখন বলতে শুরু করেছেন, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কী হতে যাচ্ছে তা চার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল দেখে কিছুটা অনুভব করা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের অবর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপির ক্ষমতার মসনদে বসা যেখানে আনুষ্ঠানিকতা মাত্র, সেখানে বাগড়া দিয়েছে জামায়াত। তারা এখন ক্ষমতার চেয়ারে ভাগ বসাতে চায়। যদিও এর আগে ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট সরকারে ছিল তাদের দু’জন মন্ত্রী। কিন্তু এবার তারা নিজেরাই জোট গঠন করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছে। এরই মধ্যে আটটি দল তাদের আহবানে সাড়াও দিয়েছে।

২০০৯ থেকে ২০২৫ ছিল জামায়াতের সবচেয়ে কঠিন সময়। এই সময়ে দলের শীর্ষ নেতাদের মানববতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ফাঁসি কার্যকর করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এর মাধ্যমে জামায়াতকে পুরোপুরি নির্মূল করতে চেয়েছিল দলটি। কিন্তু সেটা বাস্তবায়নতো দূরের কথা, তাদের উত্থানকেই কোনোভাবে ঠেকাতে পারেনি।

জানতে চাইলে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মাওলানা আবদুল হালিম সারবাংলাকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে না। সাবেক আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ দু’জনে তিনটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের পরিবার এখনো সাধারণ জীবনযাপন করছেন। কারণ, তারা দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেননি।’

তিনি বলেন, ‘পতিত আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের মিথ্যা মামলায় বিচারিক হত্যা করলেও দুর্নীতি-অনিয়মের কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি। কারণ, জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে দুর্নীতি নাই, সন্ত্রাস নাই, চাঁদাবাজ নাই। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে দুর্নীতিমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত, চাঁদাবাজমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’

জামায়াতের জনপ্রিয়তার পেছনে কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জামায়াত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে কি না সেটা দেশের জনগণ বলতে পারবে। যার প্রতিফলন আগামী নির্বাচনে দেখবেন। তবে যারা জনগণের জন্য কাজ করে তারাই জনপ্রিয় হয়।’

জামায়াতের রাজনীতি নিয়ে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামছুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জামায়াত রাজনীতিতে অনেকটা এগিয়ে গেছে। রাজনৈতিক শক্তিমত্বায় এর আগে জামায়াত তৃতীয়-চতুর্থ পজিশনে ছিল। বর্তমানে তারা দ্বিতীয় পজিশনে চলে এসেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রথম স্থানও বলা যায়।’

তিনি বলেন, ‘এদেশের মানুষ অতীতে বহু রকম বুর্জোয়া রাজনীতি দেখেছে। চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি। কিন্তু জামায়াতের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ খুব একটা শোনা যায় না। তারা পরিকল্পিতভাবে নিজেদের পকেটের টাকায় রাজনীতি করে। দেশের সাধারণ মানুষ এখন সবকিছু দেখে ও বোঝে। আমি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে রাস্তাঘাটে ও বাজারে যাই। জামায়াত যে ভালো করছে এটা এখন সব জায়গায় আওয়াজ পাওয়া যায়। মানুষ সবাইকে দেখেছে। এখন জামায়াতকে দেখতে চায়। বিশেষ করে যুব সমাজ অন্যায় কাজ সহ্য করতে পারে না। তাদের মধ্যেও জামায়াতের সমর্থন বেড়েছে।’

ড. শামছুল আলম বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে আট দল নিয়ে তাদের পরিকল্পনা; আর এই পরিকল্পনা যদি সঠিকভাবে করতে পারে, তাদের মধ্যে যদি ভালো বোঝাপড়া ও সমঝোতা হয়, যদি শেষ পর্যন্ত এক থাকতে পারে তাহলে আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায়ও যেতে পারে।’

সারাবাংলা/এমএমএইচ/পিটিএম
বিজ্ঞাপন

আরো

মো. মহসিন হোসেন - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর